শেষ আপডেট: 4th January 2025 00:03
বাংলাদেশে মহম্মদ ইউনুসের অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লিগের ছাত্র শাখা ছাত্র লিগকে নিষিদ্ধ ঘোষণার কথা সকলেরই জানা। এই উপমহাদেশে প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িকতা এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠার রাজনীতিতে যে ছাত্র সংগঠনগুলির অবদান অনস্বীকার্য, বাংলাদেশের ছাত্র লিগ তাদের অন্যতম। তাই উপমহাদেশের মানুষের জানা দরকার ৭৬ বছর আগে ছাত্রা শুরু করা এই সংগঠনটির রাজনীতিতে অবদান। এক কথায়, ছাত্র লিগ সেই বিরল সংগঠনগুলির একটি যাদের নেতৃত্বে একটি দেশ স্বাধীন হয়েছে। সে দেশের পতাকা উত্তোলন এবং জাতীয় সঙ্গীতও প্রখম গাওয়া হয়েছিল এই সংগঠনের কর্মসূচিতে।
বাঙালির আত্মপরিচয় সগৌরবে আদায় করার লক্ষ্যে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ছাত্র লিগের জন্ম। ভাষা আন্দোলনে মাধ্যমে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি আদায় ছাত্র লিগের স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায়। ছাত্র সংগঠনটির জন্ম হয়েছিল বাঙালি জাতিকে পাকিস্তানের দুঃশাসন থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে।
প্রতিষ্ঠার পর পরই ২ মার্চ ছাত্র সংগঠনটির উদ্যোগে ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চকে তারা ‘বাংলা ভাষা দাবি দিবস’ ঘোষণা করে। সেদিনই হরতাল কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে সচিবালয়ের সামনে থেকে গ্রেফতার হন ছাত্র লিগ নেতা তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান। মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ এর ক’দিন পর ঢাকায় এসে ঘোষণা করেন, ‘উর্দু, শুধু উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ সভাস্থলেই ছাত্র লিগের প্রতিবাদের মুখে পড়েন তিনি।
বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী-তে লিখেছেন, ‘ছাত্র লিগ প্রতিষ্ঠান গঠন করার সঙ্গে সঙ্গে বিরাট সাড়া পাওয়া গেল। এক মাসের মধ্যে আমি প্রায় সকল জেলায় কমিটি করতে সক্ষম হলাম।একদল সহকর্মী পেয়েছিলাম, যারা সত্যিকারের নিঃস্বার্থ কর্মী।’ গোয়েন্দা সূত্র (সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইন্টালিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দি নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রথম খণ্ড) থেকে আমরা জানতে পারি, ১১ মার্চের হরতাল সফল করার জন্য পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লিগ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ শিরোনামে যে লিফলেট বিলি করেছে সেটা ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের নামে। এই লিফলেট স্কুল-কলেজে-দোকানে বিলি হয়। ‘বিখ্যাত আমতলায় এই আমার প্রথম সভাপতিত্ব করতে হল।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী,পৃষ্ঠা ৯৬)
১৯৫২ সালে বাংলা ভাষা মুক্তির সোপান রচিত হয় ছাত্র লিগের হাতেই। বলে রাখা ভাল আওয়ামী লিগের আগে ছাত্র লিগের জন্ম দেন বঙ্গবন্ধু। ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় অসাম্প্রদায়িক বাংলার বীজ বঙ্গবন্ধু বাল্যকালেই ধারণ করেছিলেন। শুধু ছিল বাস্তবায়নের অপেক্ষা। বাস্তবায়নের ভিশন ছিল বাংলাদেশ। হাতিয়ার হল আওয়ামী লিগ। আওয়ামী লিগের অক্সিজেন হল ছাত্র লিগ।
প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সংগঠনটি অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধে উদ্বুদ্ধ ছিল। ৫৩ সালের কাউন্সিলে তাই নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লিগ নামে পথ চলা শুরু করে।
’৫৮ সালে স্বৈরশাসক আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করলে ছাত্র লিগ সেই কালা কানুনের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলে। ৬২ সালে শরিফ কমিশন ও হামুদুর রহমান কমিশনের শিক্ষানীতি, রবীন্দ্র চর্চা নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আন্দোলন গড়ে তোলে এই ছাত্র সংগঠন। অবশেষে বাঙালি জাতির উপর উর্দু চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত স্থগিত হয়।
ছাত্র লিগ ছিল বঙ্গবন্ধুর ভ্যানগার্ড। তাঁর সিদ্ধান্ত, নির্দেশনা পূর্ব বাংলার প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব ছিল ছাত্র লিগের। ফলে সময়ের পরিক্রমায় বঙ্গবন্ধু নিজ যোগ্যতায় হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতির একমাত্র বিশ্বাসের প্রতীক। একমাত্র নেতা। একমাত্র অস্তিত্বের প্রতীক। তৈরি করে ছিলেন একঝাঁক বিশ্বস্ত কর্মীবাহিনী।
৬৬-র ছয় দফা ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। আইয়ুব খানের সরকার ব্যাপক নির্যাতন শুরু করে ছাত্র লিগ, আওয়ামী লিগ নেতাকর্মীদের উপর। বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য’ তথা ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ দিয়ে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলানোর সকল পরিকল্পনা করে পাকিস্তান সরকার। আন্দোলন থেকে গণআন্দোলনে রুপ নিয়ে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আগরতলা মামলা প্রত্যাহার এবং বঙ্গবন্ধুসহ সব রাজবন্দির মুক্তি দিতে বাধ্য হন আইয়ুব খান। জেলমুক্তির পর ২৩ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ছাত্র জনতার গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠানে শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়
৬৯ সালের গণআন্দোলন থেকে গণঅভ্যুত্থান বাঙালি জাতির জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। লৌহমানব খ্যাত আইয়ুব খানের পতনকে নিশ্চিত করে। একেকটি সোপান তৈরি ও তা অতিক্রমণের মধ্য দিয়ে ছাত্র লিগ ৭০-এর নির্বাচনকে প্রশান্ত চিত্তে আলিঙ্গন করে। প্রতিটি আন্দোলনের স্রোতধারায় দোল খাইয়ে বাঙালি জাতির চেতনাকে হৃদয়ে এমনভাবে প্রতিস্থাপিত করে যে, বঙ্গবন্ধুকে আন্দোলনের প্রতীক বানিয়ে ছাত্র লিগ আন্দোলনটিকে স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার এবং স্বাধিকার থেকে শুধু স্বাধীনতায় রূপান্তরিতই করেনি, তখনকার বাংলার জাগ্রত জনতার চিত্তকে এতটাই শানিত করে যে, নিরস্ত্র জাতি পৃথিবীর সব চাইতে হিংস্র ও পৈশাচিক সেনাশক্তিকে শুধু মোকাবিলাই করেনি, পর্যুদস্ত করার মাধ্যমে পরাধীনতার বক্ষ বিদীর্ণ করে স্বাধীনতার প্রদীপ্ত সূর্যকে ছিনিয়ে আনে।
৬৯-এর বিজয়ের সাফল্যের পথ ধরেই ’৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে আওয়ামী লিগের বিজয় এবং ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে পটভূমি রচিত হয়। ইয়াহিয়া খানের ষড়যন্ত্র স্পষ্ট হতেই ২ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ছাত্র লিগ স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে। ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পল্টনে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ, জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সংগীত পরিবেশিত হয়। এরপর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু সেই ঐতিহাসিক ভাষণ, স্বাধীনতার মন্ত্র ঘোষণা, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধুর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালের পৃথিবীর বুকে জন্ম নেওয়া স্বাধীন দেশ। বাঙ্গালির দেশ বাংলাদেশ।
যে মুক্তি সংগ্রামের নায়ক ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, আর অন্যতম কারিগর ছিল ছাত্র লিগ। রাতের সব তারা যেমন লুকিয়ে থাকে দিনের আলোর গভীরে, তেমনি স্বাধীনতার চেতনাটি লুকিয়ে ছিল ছাত্র লিগের মননে। দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ৩০ লক্ষ শহিদ ২ লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে পাওয়া এই দেশ বঙ্গবন্ধু নিজের আত্মায় ধারণ করে গঠন করেছিলেন। ৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর স্বাধীনতা বিরোধী ও পাকিস্তানিরা আবার তাদের নব্য সংস্করণে বাংলাদেশকে দখল করে নেয়।
ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় বারে বারে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টা করা হয়। ঠিক একই ভাবে ২০২৪ সালে তথাকথিত কোটা আন্দোলনের নামে সারা বাংলাদেশে হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে ইউনুস, সমন্বয়ক, জামায়াত, ছাত্র শিবির, জঙ্গি হিজবুত তাহিরির মিলে নির্বাচিত শেখ হাসিনার সরকাররে ‘মেটিকুল্যাস ডিজাইনজ ক্যু’-র মাধ্যমে সরিয়ে দিয়ে দেশকে পাকিস্তান বানাতে চাইছে। বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মুক্তিযোদ্ধা, আওয়ামী লিগকে বর্তমান সরকার মুছে দিতে চাইছে। চাইছে বাংলাদেশকে জঙ্গিদের রাষ্ট্র বানাতে।
কিন্তু বাংলার মাটিকে যেমন পৃথিবীর বুক থেকে নিষিদ্ধ করা সম্ভব নয়, পৃথিবীর মানচিত্র থেকে ছিঁড়ে ফেলা সম্ভব নয়, বাংলার আলো বাতাস কৃষ্টি কালচারকে যেমন মুছে ফেলা সম্ভব নয়, তেমনই বাংলাদেশ নামক মহাকাব্য থেকে থেকে বঙ্গবন্ধু, ছাত্র লিগ, আওয়ামী লিগকে মুছে ফেলা অসম্ভব। জয় বাংলা
লেখক: শিক্ষক, মতামত ব্যক্তিগত