মতিয়া চৌধুরী।
শেষ আপডেট: 16th October 2024 17:59
অমল সরকার
চলে গেলেন বাংলাদেশের রাজনীতির প্রথমসারির জনপ্রিয় নেত্রী মতিয়া চৌধুরী। আওয়ামী লিগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ৮২ বছর বয়সি এই প্রবীণা ঢাকার একটি হাসপাতালে বুধবার দুপুরে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
ছাত্র রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে আওয়ামী লিগের নেত্রী এবং পরবর্তী সময়ে মন্ত্রী, সংসদের উপনেতা—সত্তর বছরের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি ছিলেন দল নির্বিশেষে সর্বজন শ্রদ্ধেয়, অজাতশত্রু এক ব্যক্তিত্ব। সেই কারণেই শেখ হাসিনার ছায়াসঙ্গী হওয়া সত্ত্বেও গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে তাঁকে আত্মগোপন করতে হয়নি। কেউ তাঁকে নিয়ে কটু কথা বলেনি। ঢাকার বাড়িতেই বার্ধক্যজনিত অসুখের চিকিৎসা চলছিল। পরে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাঁর স্বামী প্রয়াত বজলুর রহমান ছিলেন প্রখ্যাত সাংবাদিক। তাঁকে বলা হয় বাংলাদেশে সাংবাদিকদের গুরু।
রাজনীতির গোড়া থেকে শেখ মুজিবুরের সংস্পর্শে বেড়ে ওঠা মতিয়া নৈতিকতা, সততার প্রশ্নে ছিলেন দলের ঊর্ধ্বে সকলের কাছে আদর্শ স্থানীয়। নেতা থেকে সাধারণ মানুষ সকলে আক্ষেপ করতেন দেশ দ্বিতীয় একজন মতিয়া চৌধুরী পেল না বলে।
দীর্ঘদিন সাংসদ, মন্ত্রী, সংসদের উপনেতা থাকলেও গাড়ি-বাড়ি করেননি। সাংসদ থাকাকালে ট্রেনে-বাসে-রিকশয় যাতায়াত করতেন। সংসদ সদস্য হিসাবে সুদ এবং করমুক্ত দামে সস্তায় ভাল গাড়ি কেনার সুযোগও প্রত্যাখান করেছিলেন রাজনীতির বিনিময়ে সরকারি সুবিধা নেবেন না বলে।
এভাবেই সরকারি বাসে চলাফেরা করতেন আওয়ামী লিগের শীর্ষস্থানীয় নেত্রী।
দেশবাসীর দারিদ্র্যের কথা বিবেচনায় রেখে অতিসাধারণ জীবনযাপন করতেন তিনি। পরতেন সস্তার তাঁতের শাড়ি। মন্ত্রী-সাংসদ থাকাকালেও রান্না, জামা-কাপড় কাঁচার মতো ব্যক্তিগত কাজ নিজের হাতে করতেন, সরকারি কর্মচারীদের দিয়ে এসব করাতেন না।
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নানের কথায়, ‘বলতে পারেন তিনি ছিলেন বাংলাদেশের নারী গান্ধী। আমি আজীবন ওঁকে সস্তার তাঁতের শাড়ি পরতে দেখেছি। সামর্থ থাকলেও স্বচ্ছ্বল জীবন সযত্নে এড়িয়ে চলতেন। সকলের জন্য অবারিত ছিল তাঁর বাড়ি-অফিস।’
বাংলাদেশের জনপ্রিয় অভিনেতা আসাদুজ্জামান নুরকে এক সাক্ষাৎকারে মতিয়া একবার সাজগোজ নিয়ে বলেছিলেন, ‘বিয়ের দিন পরিবারের ইচ্ছায় সাজতে হয়েছিল। আর কখনও সাজগোজ ভাবিনি। সাজগোজ করে, দামি পোশাকআশাক পরে রাজনীতি করা যায় না। মানুষ দূরে সরে যায়।’
ঢাকা মেট্রোরেলের উদ্বোধনের দিন হাসিনা, তাঁর বোন রেহানার মাঝে মতিয়া চৌধুরী।
অধ্যাপক মান্নান আরও বলেন, ‘সেই মতিয়া চৌধুরী একবার সংসদ নির্বাচনে হেরে যান। আমি নিছকই কৌতূহলবশত হারের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানতে পারি, প্রবল রাগে কাছের লোকেরাই হারিয়ে দেয় তাঁকে। কারণ, তাদের তিনি কোনও সুযোগ-সুবিধা দেননি। আসলে রাজনীতি ভাঙিয়ে ব্যক্তিগত টাকা-পয়সা করা, স্বজনপোষণ থেকে থাকতেন শতহস্ত দূরে। পরিচিতদের বলতেন, ‘চাকরি দরকার হলে চাকরির পরীক্ষা দাও। আমার কাছে লাইন ভেঙে সুবিধা আশা কোরো না।’
আওয়ামী লিগের সর্বোচ্চ সাংগঠনির কমিটি প্রেসিডিয়ামের সদস্য তথা সংসদের উপনেতা হওয়া মতিয়া চৌধুরীর রাজনীতিতে হাতেখড়ি বাম শিবিরে। সত্তরের দশকে উপমহাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি বেজিং ও মস্কোপন্থীতে ভাগ হয়ে গেলে মতিয়া রুশপন্থীদের সঙ্গে ছিলেন। কারণ, চিন তখন পাকিস্তান পন্থী।
ছাত্র ইউনিয়নের নেত্রী হিসাবে সামরিক শাসক আয়ুব খানের সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় থেকেই মতিয়া অগ্নিকন্যা নামে খ্যাত। মেয়ে রাজনীতি করায় তাঁর পুলিশ অফিসার বাবাকে পদে পদে হেনস্থা করত সামরিক সরকার। বাবাকে সরকারের রোষ থেকে কক্ষা করতে পড়াশুনোর পর্ব শেষ করার আগেই বিয়ে করে নেন মতিয়া। যদিও বিয়ের এক মাসের মাথায় গ্রেফতার হয়ে দীর্ঘদিন কারাগারে কাটাতে হয়। রাজনীতির কারণেই কলেজের পড়াশুনোয় ছেদ পড়ে তাঁর।
বাম রাজনীতি থেকে আওয়ামী লিগে যোগদানের পরও বহু বছর তাঁর জেলে কাটে। স্বাধীন দেশে দুই সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান এবং হুসেইন মহম্মদ এরশাদের সময়েও বারে বারে জেলে যেতে হয় তাঁকে।
মুজিবুর রহমানের সঙ্গে রাজনীতি করা মতিয়া বঙ্গবন্ধু কন্যা হাসিনাকে চোখের মণির মতো আগলে রাখতেন। হাসিনাও দলের এই নেত্রীকে প্রাপ্য মর্যাদা দিয়ে সর্বদা কাছে কাছে রাখতেন। প্রধানমন্ত্রী কিংবা দলনেত্রী, সরকারি প্রকল্পের অনুষ্ঠানে হাসিনার পাশের আসনটি বরাদ্দ থাকত মতিয়া চৌধুরীর জন্য।
১৯৯৬-এ হাসিনা প্রথমবার সরকার গড়লে মতিয়া চৌধুরীকে কৃষিমন্ত্রী করেছিলেন। আওয়ামী লিগের কৃষক সেলের নেত্রী হিসাবে দেশের চাষআবাদ, কৃষকের সমস্যা সম্পর্কে ধারণা ছিল তাঁর। কৃষিমন্ত্রী হয়ে মতিয়া দেশে সারের দাম অর্ধেক করে দিয়েছিলেন। অনেকেই বলে থাকেন, বাংলাদেশের ধান এবং সবজি উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জনে মতিয়া চৌধুরীর অবদান অনস্বীকার্য।
দলেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন এই নেত্রী। মুজিব হত্যার পর আওয়ামী লিগকে নতুন করে সক্রিয় করে তোলা, শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরানোর সময়ে বিশেষ ভূমিকা নেন মতিয়া। সেই হাসিনা ও আওয়ামী লিগের সংকটের সময় চলে গেলেন সময়ের পরীক্ষায় উত্তীণ নির্ভরযোগ্য নেত্রী।