শেষ আপডেট: 9th December 2024 10:27
সোমবার একদিনের সফরে ঢাকা যাচ্ছেন ভারতের বিদেশ সচিব বিক্রম মিস্রি। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর নিপীড়নের অভিযোগ, শেখ হাসিনাকে ভারতে আশ্রয় দেওয়া এবং দুই দেশেই জাতীয় পতাকা, প্রতীকের অবমাননার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সম্পর্কের শীতলতা বিরাজ করছে। বিদেশ সচিবের সফরের আগের দিন রবিবার ‘দ্য ওয়াল’ কথা বলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, নোবেলজয়ী মহম্মদ ইউনুসের প্রেস সচিব শফিকুল আলমের সঙ্গে। কলকাতা থেকে তাঁর সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন দ্য ওয়াল-এর এক্সিকিউটিভ এডিটর অমল সরকার।
মূল কথা
• ভারতের বিদেশ সচিবের সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের ঘনিষ্ঠতা বাড়বে এবং যার ভিত্তি হবে পারস্পরিক মর্যাদা।
• সংখ্যালঘু নিপীড়নের ঘটনাগুলি অতিপ্রচার। এই ব্যাপারে ভারতীয় মিডিয়ার আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা দরকার। ভারতীয় মিডিয়াকে স্বাগত। তাঁরা বাংলাদেশে এসে দেখে যাক, সত্যটা কী। দেশ পুরোপুরি স্বাভাবিক।
• চিন্ময়কৃষ্ণের মুক্তির বিষয়ে আইন মেনেই যা সিদ্ধান্ত হওয়ার হবে।
• সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর দলের শাসনামলের দেশবাসীর উপর নিপীড়ন, নির্যাতন, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, দেশের অর্থনীতিকে ধ্বসং করার মতো কৃতকর্মের জন্য আওয়ামী লিগ ক্ষমা না চাইলে রাজনীতিতে তাদের প্রত্যাবর্তন কঠিন।
• গণহত্যা এবং নিপীড়ন, নির্যাতনের ঘটনায় যুক্ত প্রত্যেকের বিচার করা হবে। সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত নীচে প্রকাশ করা হল।
• চারমাসে মহম্মদ ইউনুসের অন্তর্বর্তী সরকার দেশকে ভঙ্গুর অবস্থা থেকে উদ্ধার করেছে।
• তবে গণ অভ্যুত্থানের পর যে ধরনের প্রতিহিংসা, হত্যাকাণ্ড হবে বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল তা হয়নি। সরকার এবং রাজনৈতিক দল তা ঠেকিয়ে দিয়েছে। মিনিমাম ডেথ হয়েছে। একটি মৃত্যুও দুঃখজনক।
নীচে সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত উল্লেখ করা হল-
ভারতের বিদেশ সচিবের ঢাকা সফর
আমরা ভারতের বিদেশ সচিবের বাংলাদেশে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত। বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে উনিই সম্ভবত প্রথম এত উচ্চপদস্থ বিদেশকর্তা বাংলাদেশ সফর করছেন। আমরা চাইব, আমাদের সঙ্গে ভারতের যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে, তা আরও সুদৃঢ় হোক। কমন ইন্টারেস্টের বিষয় নিয়ে নতুন করে কথাবার্তা বলে আমরা সুন্দর পরিবেশ তৈরি করতে চাই।
ভারত থেকে হাসিনার বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তণ
আমি নির্দিষ্টভাবে বলতে পারছি না বিদেশ সচিবের সঙ্গে বৈঠকে এই বিষয় নিয়ে কথা হবে কিনা। তবে আমাদের কিছু আইনি ব্যাপার আছে, সেগুলো সারার পরে আমরা শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তন চাইব। আমাদের সঙ্গে ভারতের প্রত্যাবর্তন-চুক্তি আছে, সেইমতোই প্রক্রিয়া এগোবে। হাসিনা যেহেতু গণহত্যাকারী, একনায়কতন্ত্রের নায়ক, তিনি অসংখ্য মানুষকে খুন করেছেন, গুম করেছেন, ৫০ লক্ষের বেশি বিরোধীকে মামলায় ফাঁসিয়েছেন, বহু ম্যাসাকার ঘটিয়েছেন, বিচারবহির্ভূত হত্যা করেছেন, তাই আমরা তো তাঁকে দেশে ফেরত চাইবই। তবে সবটাই প্রত্যাবর্তন চুক্তি মেনে হবে।
হাসিনার দল তাঁকে এখনও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলে দাবি করছে
উনি একরকম ডিলুউশনে আছেন। বাস্তবটা তো বাংলাদেশ জানে, গোটা বিশ্ব জানে। এখন উনি যদি এরকম মিথ্যা ধারণা নিয়ে থাকেন, তাহলে আর কী করা যাবে? কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, উনি এগুলো ভারতে থাকা অবস্থায় করছেন।
সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন, চিন্ময়কৃষ্ণকে গ্রেফতার
যতটা না হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি দেখানো হচ্ছে মিডিয়ায়। বিশেষ করে ভারতীয় মিডিয়াগুলি মোটেই বাংলাদেশে লোক পাঠাচ্ছেন না, বাংলাদেশে এসে খবর সংগ্রহ করছেন না। ফলে যেখানে যত অতিরঞ্জিত খবর, ভিডিও, সেগুলোই তাঁরা দেখাচ্ছেন। এতে ভুয়ো খবর প্রচারিত হচ্ছে। ওরাই পরিস্থিতি অস্থির করে তুলছেন। লোকে ভাবছে ভয়ানক একটা কিছু হচ্ছে বাংলাদেশে। আমরা তো বলছি, এসে দেখে যান। এই অস্থিরতা তৈরি করার জন্য অনেক ক্ষেত্রে ভারতে অ্যাটাকও হচ্ছে। আগরতলায় এমনই হল। আসলে মিসইনফর্মেশনের কারণেই এগুলো মানুষকে ট্রিগার করছে, মানুষকে উত্ত্যক্ত করে তুলছে। আমাদের একটাই কথা, চিন্ময়কৃষ্ণের গ্রেফতার আইনি বিষয়। আইনে যা আছে, তাই হবে। আমরা সকলের মতামত গ্রহণ করেছি। আমরা সবার কথা শোনর জন্য উন্মুক্ত।
আমেরিকা, ব্রিটেন-সহ বহু দেশ বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে
আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে ব্রিটেনের সতর্কবার্তা একটা স্ট্যান্ডার্ড অ্যালার্ট, গতবার থেকেই আছে। নতুন আপডেট হল, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের ঘটনা নিয়ে ওরা অ্যালার্ট করেছে। বাংলাদেশে বর্তমান যে সরকার, তারা মানবাধিকারের পক্ষে। মানবাধিকার নিয়ে কাজ করছে। কিন্তু বাইরের দুনিয়ায় দেখানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, এটা একটা ইসলামিস্ট সরকার। এটা ডাঁহা মিথ্যে। আমেরিকা বা ব্রিটেন তো আমাদের কিছু বলেনি। বরং আমাদের সঙ্গে বৈঠকে আমাদের সমর্থনই জানিয়েছে তারা। জো বাইডেনের সঙ্গে মহম্মদ ইউনুসের বৈঠক হয়েছে। তিনি বাংলাদেশের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন। ব্রিটেনের সিনিয়র অফিসিয়াল বা রাষ্ট্রদূতরাও তাই বলেছেন। এর বাইরে কে বিচ্ছিন্নভাবে কী বললেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প কী বললেন, তাতে কিছু এসে যায় না। এসব দেশের সরকার আমাদের সঙ্গে আছে। আপনারা ভাবছেন, পরিস্থিতি এত উত্তপ্ত, সব দেশ সরে গেছে পাশ থেকে। তা নয়। পরিস্থিতি কতটা শান্ত আছে, আপনারা এসে দেখে যান।
অন্তর্বর্তী সরকারের চারমাসে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের অবনতি
এটা অনেকে বলছেন। আমরা মনে করছি না। সম্প্রতি বাংলাদেশের ভারতীয় রাষ্ট্রদূত একটি বক্তৃতা দিয়েছেন, সেটা শুনলে এমন কিছু পাবেন না। আমরা মনে করছি, আমাদের সম্পর্ক আরও ভাল হবে। দু'দেশের মধ্যে সম্পর্কে মর্যাদা বাড়বে। আমাদের যে ঐতহাসিক যোগাযোগ, ভাষাগত সেতু, তা আরও বলিষ্ঠ করতে চাই। ন্যায্যতা ও সমতার ভিত্তিতে আরও ভাল সম্পর্ক হবে।
হাসিনাকে ভারতের আশ্রয়দান
এটা বিদেশ মন্ত্রক দেখছে। যা জানানোর তারা জানাবে। এই নিয়ে আগেও কথা হয়েছে দু-দেশের। ভারতের বিদেশ সচিব আসছেন এদেশে। উনি যা জানাবেন, সেইমতো আমাদের বিদেশ মন্ত্রক কথা বলবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য
আমি তো বলব খুবই সফল একটা সরকার। একটা ভঙ্গুর সিস্টেম, ভঙ্গুর ইনস্টিটিউট, ভঙ্গুর ইকোনমি আমরা পেয়েছিলাম। সেখান থেকে স্মুদ একটা ট্রানজিশন হয়েছে। হাসিনার ডানহাত, সেই সরকারের পরিবহণ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, হাসিনা যদি সরে যেতে বাধ্য হন, তাহলে দেশে একটা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হবে, লক্ষ লক্ষ লোক মারা যাবেন। সে জায়গায় আমাদের সরকার, নাগরিক সমাজ, আমাদের রাজনৈতিক দল অনেক ভালভাবে পরিস্থিতি হাতে নিয়েছে। একটা মৃত্যুও আমরা চাই না। মিনিমাম লোক মারা গেছেন, খুবই কম মৃত্যু হয়েছে। সবাই শান্ত থেকেছে। ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে।
স্মুদ ট্রানজিশনের আরেকটা দিক হচ্ছে, অর্থনীতির বৃদ্ধি। গত চারমাসে এক্সপোর্ট বেড়েছে অনেকটা। প্রতি মাসে গ্রোথ বাড়ছে। হাসিনার কাছের ব্যবসায়ীরা দেশের ব্যাঙ্কিং সিস্টেম ছিবড়ে করে রেখে গিয়েছিলেন। সেই জায়গা থেকে আমরা অনেক স্টেবলাইজ করেছি। হাসিনা শেষ দুবছর বিদেশি কোনও কোম্পানির পেমেন্ট করতেন না। আদানির টাকাও বাকি ছিল। আমরা একে একে সেগুলো পেমেন্ট করছি। ভঙ্গুর অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তার উপর বাংলাদেশের জনগণ চাইছিল একটা সংস্কার। নির্বাচন থেকে শুরু করে সমাজ, সমস্ত প্রতিষ্ঠান, সংবিধান-- এই সবকিছুর সংস্কার চাইছিল তারা। আমরা সেইমতোই সংস্কার কমিশন তৈরি করেছি। ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে তারা রিপোর্ট দেবে। সেই মতো আমরা আলোচনা করব রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে। তখন আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব। সবার সঙ্গে কথা বলে, সংখ্যালঘুদের সঙ্গে কথা বলে ঐকমত্যে পৌঁছলে আমরা সবটা ঠিক করব। কেউ বলতে পারবে না, আমার ভয়েস শোনা হয়নি। আমি সেটা মনে করি না।
সরকারের ব্যর্থতা
আমার মনে হয় না এমন কোনও জায়গা আছে যেখানে সরকার ব্যর্থ। আমরা বলছি, আপনারা এসে দেখে যান এখানে, আমরা কী করেছি, আর কী পেরেছি। আমরা একটা মিস ইনফর্মেশন ক্যাম্পেন ও ভুল ধারণার শিকার। আপনারা এসে থাকুন, কথা বলুন, মানুষের সঙ্গে মিশুন, খবর করুন। আমরা আপনাদের থেকে ফেয়ার জার্নালিজম চাই। মিথ্যা রিপোর্টে তিক্ততা বাড়ে।
আওয়ামী লিগকে নিয়ে সরকারের অবস্থান
আওয়ামী লিগকে ফিরতে দেওয়া হবে না—এ কথা আমরা বলছি বলছি না। আমরা বলেছি, এখনকার স্ট্রাকচারে আওয়ামী লিগ একটা ফ্যাসিস্ট পার্টি। সেই ফ্যাসিস্ট পার্টি আর ফিরবে না। গত ১৫ বছরের অপশাসন, এবছরের জুলাই-অগস্টের গণহত্যা-- এই নিয়ে অনেক ডকুমেন্ট, ভিডিও, প্রমাণ আছে। তাছাড়া বিপুল দুর্নীতি হয়েছে। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি বলেছে, প্রতি বছর ১৬ বিলিয়ন ডলার করে সাইফন অফ হয়েছে। এই নিয়ে আওয়ামী লিগে কোনও অনুশোচনা আছে? কোনও দুঃখপ্রকাশ আছে? এত বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়ে যে মারা গেল, কেউ বলল না, এ জন্য তারা দুঃখিত। এই পরিস্থিতিতে রিকনসিলিয়েশনের পথ সুগম কী করে হবে? হাসিনা বা তার দল যদি দুঃখপ্রকাশ না করে, তাহলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে কেন? যাদের হাতে রক্ত আছে, তাদের বিচার অবশ্যই হবে। বাংলাদেশের স্বার্থেই হবে। কিন্তু আমরা কাউকে ব্যান করছি না।
আমরা কোনও মাইনাসে নেই। আমরা ফেসিলিটেটর হিসেবে কাজ করছি। রিফর্মেশন কমিটিগুলি যা বলবে এবং বাংলাদেশের মানুষ যা বেছে নেবে, সেই মতো কাজ হবে। এতে কোনও রাজনীতি নেই। এই রিফর্মেশন কবে শেষ হবে, আমি বলতে পারছি না। সেটা হলে তখনই নতুন বাংলাদেশ তৈরি হবে। আমরা ওপেন। ওপেননেসের থেকে বড় কিছু বিশ্বে নেই।