Date : 16th May, 2025 | Call 1800 452 567 | [email protected]
Bangladesh: শেখ হাসিনার ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় বাংলাদেশ SSC: শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে পুলিশের বেধড়ক লাঠিচার্জ, শুক্রবার রাজ্যজুড়ে 'ধিক্কার দিবস' পালনের ডাক চাকরিহারা শিক্ষকদেরNew Delhi: ভারতের অ্যাকশন, বিমানবন্দরের পরিষেবায় পাক 'বন্ধু' তুরস্কের সংস্থায় 'না' ভারতের, বাতিল 'সুরক্ষা ছাড়পত্র'Indian Army: পাকিস্তানে 'অপারেশন সিঁদুর'-এর পর বাংলাদেশের নাকের ডগায় ভারতীয় সেনার মহড়া 'তিস্তা প্রহার'SSC: কসবার স্মৃতি ফিরল বিকাশ ভবনে, চাকরি ফেরত চাওয়ায় শিক্ষক পেটালো পুলিশ, ঝরল রক্তসৌরভ, সানা, নাচ,সংসার নিয়ে মন খুলে আড্ডায় ডোনাউকিল বর্মন জানালেন বাংলাদেশের জেলে অনেকেই তাঁকে দেখতে ভিড় করতবাঙালির কাছে তিনি মহানায়ক, তবে স্কুলেও পড়াতেন উত্তম কুমার, কোন বিষয় জানেন?ভারতের তরফে 'শুল্ক মকুবের প্রস্তাব': ট্রাম্পের দাবি মানলেন না জয়শঙ্কর, জানালেন, 'আলোচনা চলছে'SSC: সাইরেন বাজিয়ে চাকরিহারা শিক্ষকদের ওপর পুলিশি লার্ঠিচার্জের অভিযোগ! রণক্ষেত্র বিকাশভবন
Bangladesh News

গ্রিক পুরাণের গল্প ও বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম বিচার দাবি

তখন সামরিকতন্ত্রের বুটে পিষ্ট গণতন্ত্র। বাকস্বাধীনতা ছিল না দেশে। দেশের বাইরেও কেউ এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রতিবাদ করার সাহস দেখাতে পারেনি।

গ্রিক পুরাণের গল্প ও বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম বিচার দাবি

ফাইল ছবি

শেষ আপডেট: 10 May 2025 00:01

এম নজরুল ইসলাম

১৫ আগস্ট ১৯৭৫। ইতিহাসের এক জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল এই দিনে। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে সেদিন রাতের নিস্তব্ধতাকে বিদীর্ণ করেছিল একদল হায়েনার পৈশাচিক উল্লাস। ওরা হামলে পড়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে। সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ছোট্ট শিশু রাসেলও রক্ষা পায়নি ওদের নিষ্ঠুরতা থেকে। এরপর এক দীর্ঘ সময় দেশে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ ছিল প্রায় নিষিদ্ধ। সে এক দুঃসহ দিন। জাতি ছিল স্তম্ভিত, দিকনির্দেশনাহীন।

তখন সামরিকতন্ত্রের বুটে পিষ্ট গণতন্ত্র। বাকস্বাধীনতা ছিল না দেশে। দেশের বাইরেও কেউ এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রতিবাদ করার সাহস দেখাতে পারেনি। জাতির জনকের নৃশংস হত্যাকাণ্ড এমন এক অবিশ্বাস্য ও নারকীয় ঘটনা ছিল যে পুরো দেশ শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে। দিশা হারিয়ে ফেলে। ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে তখন কবরের নীরবতা। 

বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা, শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা, দেশের বাইরে থাকায় সেদিন প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। দেশের ভেতরে ও বাইরে এই পৈশাচিক হ্ত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কিছু প্রতিবাদ, নিন্দা, সমালোচনা হলেও সামরিকতন্ত্র ও বিদেশি ষড়যন্ত্রের কারণে সেগুলো খুব একটা জোরালো হতে পারেনি। অবশেষে এল সেই দিনটি, ১০ মে ১৯৭৯ সাল । সুইডেনের স্টকহোমে এক সমাবেশে দাঁড়িয়ে সমাবেশের প্রধান অতিথি শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাঁর পাঠানো বাণী পাঠ করেন ছোট বোন শেখ রেহানা। বড় বোনোর পক্ষে বক্তব্যও দেন তিনি। আন্তর্জাতিক এই সম্মেলনের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে তিনিই সর্বপ্রথম পঁচাত্তরের কলঙ্কজনক ও অমানবিক হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবি তোলেন।

শেখ রেহানা বক্তব্য রাখছেন

ইউরোপের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, জাতিসংঘের মহাসচিব, জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস কমিশনের চেয়ারম্যান, যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের হিউম্যান রাইটস কমিটির চেয়ারম্যান, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের প্রধানদের কাছে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যার বিচারের দাবিতে বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার অনুরোধ জানান শেখ রেহানা। পঁচাত্তরের পৈশাচিক বর্ণনা দিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে শেখ রেহানার আবেগঘন বক্তব্য সেই অনুষ্ঠানে এক হৃদয়বিদারক পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। হল ভর্তি প্রবাসী বাঙালি নারী-পুরুষ এবং বিদেশি রাজনীতিবিদ, পার্লামেন্ট সদস্য ও সাংবাদিক পিনপতন নীরবতায় তাঁর বক্তব্য শোনেন। 

সেদিন স্টকহোমের অনুষ্ঠিত হয়েছিল সর্ব ইউরোপিও বাকশালের এক সম্মেলন। ওই সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনাকে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদানের জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছিল। কিন্তু তখন ভারত থেকে সুদূর সুইডেনে গিয়ে সম্মেলনে যোগ দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। সর্ব ইউরোপিও নেতারা শেখ হাসিনার প্রতিনিধিত্ব করতে শেখ রেহানাকে অনুরোধ করেন। দিল্লি থেকে ফোনে শেখ হাসিনাও বোনকে বলেন সম্মেলনে যেতে। অনুষ্ঠানে কী বলতে হবে সে বিষয়ে তিনি টেলিফোনে ছোট বোনকে নির্দেশনা দেন। শেখ রেহানা সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। সুইডেনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত আবদুর রাজ্জাকের আন্তরিক চেষ্টায় এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লিগের বর্তমান সভাপতি সুলতান মাহমুদ শরিফ, স্পেনের সাবেক রাষ্ট্রদূত শেলী জামান ও সেলিমুজ্জামান।

পৌরাণিক অনেক গল্প আছে, যেগুলোর সঙ্গে অনেক রাজনৈতিক ঘটনার মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এমনই এক গল্পের প্রধান চরিত্র ইলেকট্রা, গ্রিক ট্র্যাজেডিগুলোর মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় এক পৌরাণিক চরিত্র। সফোক্লিসের ইলেকট্রা এবং ইউরিপিদেসের ইলেকট্রা, দুটি গ্রিক ট্র্যাজেডির প্রধান চরিত্র হিসেবে আমরা তাঁকে পাই। ইস্কিলাস, আলফিয়েরি ভলতাইরে, হফম্যানস্থাল এবং ইউজিন ও’ নিল প্রমুখের নাটকেরও কেন্দ্রীয় চরিত্র ইলেকট্রা। গ্রিক পুরাণে ইলেকট্রা ছিলেন রাজা আগামেমননের কন্যা। রাজা আগামেমনন ছিলেন ট্রয় যুদ্ধে গ্রিকদের প্রধান সেনাপতি। অগিস্থাস আগামেমননকে হত্যা করে সিংহাসনে বসেন। ইলেকট্রা ও তাঁর ভাই ওরেস্তেস যৌথভাবে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। তেমনি জাতির পিতার দুই কন্যা পিতৃহত্যার বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়েছিলেন। তাঁরা বিশ্বমানবতার কাছে পিতৃহত্যার বিচার চেয়েছিলেন। বিচার চেয়েছিলেন ইতিহাসের এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের। পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের মাধ্যমে দেশ ও জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। আর এই কলঙ্কমোচনের প্রথম সোপান রচিত হয়েছিল আজকের এই দিনে সুদূর সুইডেনে।

কবি শামসুর রাহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি ও রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর কন্যার মধ্যে আগামেমনন ও ইলেকট্রা এই দুটি চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর কবিতায়। লিখেছেন, ‘আড়ালে বিলাপ করি একা একা, ক্ষুধার্ত পিতা/তোমার জন্য প্রকাশ্যে শোক করাটাও অপরাধ।/এমন কি হায়, আমার সকল স্বপ্নেও তুমি/নিষিদ্ধ আজ; তোমার দুহিতা একি গুরুভার বয়!’

১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর জাতি ছিল স্তম্ভিত, দিকনির্দেশনাহীন। দলের অনেকেই তখন ঘাতকদের সঙ্গে আঁতাত করে ক্ষমতার ভাগাভাগিতে ব্যস্ত। কবি শামসুর রাহমান লিখেছেন, ‘শ্রাবণের মেঘ আকাশে আকাশে জটলা পাকায়/মেঘময়তায় ঘন ঘন আজ একি বিদ্যুৎ জ্বলে।/মিত্র কোথাও আশেপাশে নেই, শান্তি উধাও :/নির্দয় স্মৃতি মিতালি পাতায় শত করোটির সাথে।’

ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে তখন কবরের নীরবতা। অথচ এই বাড়িতে একদিন কত মানুষের সমাগম হতো রোজ। যেমন কবি শামসুর রাহমান লিখেছেন, ‘পিতৃভবনে শুনেছি অনেক চারণের গাঁথা,/লায়ারের তারে হৃদয় বেজেছে সুদূর মদির সুরে।/একদা এখানে কত বিদূষক প্রসাদ কুড়িয়ে/হয়েছে ধন্য, প্রধান কক্ষ ফুলে ফুলে গেছে ছেয়ে।’

তখন দেশে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ প্রায় নিষিদ্ধ। যেমনটি শামসুর রাহমান তাঁর কবিতায় লিখেছেন, ‘সেই দিন আজো জ্বলজ্বলে স্মৃতি. যেদিন মহান/বিজয়া সে বীর দূর দেশ থেকে স্বদেশে এলেন ফিরে।/শুনেছি সেদিন জয়ঢাক আর জন-উল্লাস;/পথে-প্রান্তরে তাঁরই কীর্তন, তিনিই মুক্তিদূত।...নন্দিত সেই নায়ক অমোঘ নিয়তির টানে/গরীয়ান এক প্রাসাদের মতো বিপুল গেলেন ধসে।/বিদেশী মাটিতে ঝরেনি রক্ত; নিজ বাসভূমে,/নিজ বাসগৃহে নিরস্ত্র তাঁকে সহসা হেনেছে ওরা।’

১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে দীর্ঘ ২১ বছর পর আবার আওয়ামী লিগকে ক্ষমতায় আসীন করেন শেখ হাসিনা। তখন ‘ইনডেমনিটি’ অধ্যাদেশ বাতিল করার জন্য তাঁর সরকার আদালতের শরণাপন্ন হয়। আদালত অধ্যাদেশটি সংবিধানের পরিপন্থী বলে রায় দেন। তারপর ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর জাতীয় সংসদে কুখ্যাত ‘ইনডেমনিটি’ অধ্যাদেশ বাতিল করা হয়।

অতঃপর ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে হত্যাকারীদের বিচার অনুষ্ঠান না করে দেশের প্রচলিত আইনে স্বাভাবিক পন্থায় বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৯৯৭ সালের ১২ মার্চ বিচারকার্য শুরু হয়। ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর বিচারক কাজী গোলাম রসুল মামলার রায় ঘোষণা করেন। ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয়।

২০০৯ সালে আওয়ামী লিগ ক্ষমতায় এলে দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হয়ে শেখ হাসিনা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পর ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর ওই আপিলের তথা মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করা হয়। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি পাঁচ আসামির ফাঁসির রায় কার্যকর হয়। এ ইতিহাস সবারই জানা।

আজ সেই দিন, যেদিন বাস্তবতায় ফিরে এসেছিল গ্রিক পুরাণের সেই গল্প। গ্রিক পুরাণের গল্পের  বোন ও ভাইয়ের পরিবর্তে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রধান চরিত্র হয়ে ফিরে এসেছিল দুই বোন। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। 

লেখক এম নজরুল ইসলাম

লেখক: সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লিগের সভাপতি এবং মানবাধিকারকর্মী, লেখক ও সাংবাদিক


ভিডিও স্টোরি