শেষ আপডেট: 13th October 2024 20:01
দ্য ওয়াল ব্যুরো: বালো অট্টবল। ছেলেবেলায় এভাবেই নিজের জন্ম তারিখ উচ্চারণ করতেন বিখ্যাত সংগীত শিল্পী ফেরদৌস আরা। বড়বেলার জন্মদিনে এমনই স্মৃতিচারণা করলেন তিনি। নিজের জীবন, কাজ ও পরিবার নিয়ে করলেন খোলামেলা আলোচনা।
শনিবার জন্মদিন ছিল সংগীত শিল্পীর। এবছর এই দিনটি শুধুই তাঁর জন্মদিন বলে স্পেশাল, তা নয়। ২ দিন আগে নাতি হয়েছে তাঁর। আর শনিবারই সে ফিরেছে বাড়ি। তাই খুশিতে আত্মহারা হয়ে সেই কথাও ভাগ করলেন। জন্মদিনের সেরা উপহারও যে নতুন সদস্য, তাও বললেন।
ফেরদৌস আরার কথায়, 'আমরা চার বোন ও এক ভাই। ছোটবেলায় ভাইয়ের জন্য যথেষ্ট করা হতো। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, পুরো বাড়িতে আমার জন্মদিন ভোলার কারও পথ ছিল না। যখন কথা বলতে পারতাম না, সবে কথা বলতে শিখছি, তখনই ১২ অক্টোবরকে বালো অট্টবল বলতাম। আর সবার কান ঝালাপালা করতাম। মা-বাবার এক ছেলে ছেলে একটা হলেও সবচেয়ে বড় আয়োজন করত আমার জন্যই।'
তিনি আরও বলেন, 'আমি বোনদের মধ্যে সবেচেয়ে ছোট। আমরা তখন এলিফ্যান্ট রোডের বাড়িতে থাকতাম। আমি আমার জীবনকে তিনটে অধ্যায়ে ভাগ করি। 'বালোই অট্টবল' (১২ অক্টোবর) মানে ছোটবেলা। তারপর হচ্ছে কিশোরকাল। কিশোরীকালে ভীষণ দুরন্ত ছিলাম। এ সময়ে জন্মদিন কেউ করল কি করল না, এসব নিয়ে কোনও গুরুত্ব দিতাম না। কিন্তু করতই। এটা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। খাওয়ানো বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশী সবাই আসত এই দিনে। জীবনের সবচেয়ে ভালো লাগার সময়টা হল বড়বেলা। গানের স্কুল সুরসপ্তক যখন প্রতিষ্ঠা করি। ২০০০ সালে এটির যাত্রা শুরু।'
জন্মদিনে পেতেন গুচ্ছের সারপ্রাইজ। এবিষয়ে বলেন, 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছি, সেখানেও শিক্ষার্থীরা আচমকা সারপ্রাইজ দিয়ে দিত, যা আমি ভাবতেও পারতাম না। প্রতিবছর আমার স্কুলের শিক্ষার্থীরাও নানাভাবে চমকে দেওয়ার চেষ্টা করে। গতকালও জামালপুর থেকে আমার এক শিক্ষার্থী এসেছিল। চমকে দিয়েছে।'
জন্মদিনে বাবাকে নিয়ে বলতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন তিনি। বলেন, 'পরপর তিনটে মেয়ে হয়েছে। বাবা ভেবেছিলেন, পরেরজন ছেলে হবে। শার্ট–প্যান্ট কিনে রেখেছিলেন। পরে আমি হলাম। তারপর ছেলে। তাই প্রথমে ওসব শার্ট-প্যান্ট আমাকে পরানো হত। আমার মানসিকতাও হয়ে গেল ছেলেদের মতো। দুরন্তপনা। দুষ্টু। টমবয়। আমাকে বাড়ির সামনের কেউ গাছ থেকে নামাতে পারত না। সারা দিন টইটই করে বেড়াতাম। আমার বাবাও খুব ভালো গাইতেন। ক্ল্যাসিক্যাল দারুণ গাইতেন। ওই সময়ের স্বনামধন্য শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পী আখতার সাদমানিরাও আমার বাবাকে ভালোবাসতেন। ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিকের ওমর ফারুক স্যারকে আমাদের ড্রয়িংরুমে অনেক দেখেছি। কারণ, বাবার কাছ থেকে বন্দিশ নেবেন। সে কারণে আমাদের শিক্ষাটা উচ্চাঙ্গসংগীতে বেশি। ছোটবেলায় আমি অনেক দুষ্টু ছিলাম বলে হয়তো বাবা গান নিয়ে আমার কাছে আশাই করতেন না। তবে বোনদের ক্ল্যাসিক্যাল শেখাতে চাইতেন।'
বাড়ির পরিবেশ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে সংগীত শিল্পী বলেন, 'ওই সময় সারা রাত আমাদের বাড়িতে আসর জমত। সবচেয়ে ছোট আমি সারা রাত জেগে ক্ল্যাসিক্যাল গিলছি। তাঁরা একদিন অবাক বললেন, এটা কার মেয়ে! এ রকম শ্রোতা তো আর এখানে নেই। তখন আমার বাবা বললেন, এই একটাই মেয়ে আমাকে জ্বালিয়ে–পুড়িয়ে শেষ করে দিচ্ছে। সে কোনওভাবে গান শিখবে না। তখন তাঁরা উর্দুতে বললেন, ওর মধ্যে কিন্তু সংগীত রয়েছে। এখানে অনেক বড় সংগীতের ওস্তাদও ঘুমিয়ে গেছে। কিন্তু ও শুনছে এক মনে। সেসব শুনে ওস্তাদ সালামত আলী ও নাজাকাত আলী একটা গান শুনতে চাইলেন। আমিও শোনালাম। আমরা তখন রাজশাহীতে থাকতাম। বাবার কাছ থেকে আমি সব সময় লুকিয়ে লুকিয়ে চলতাম। বাবা চেয়েছিলেন, আমি গানই করি। তবে বাড়ির কাউকে রাগাতে চাইলে আমি আধুনিক গাইতাম। আধুনিক গাইলে মা–বাবা দুজনই বেত নিয়ে দৌড় করাত। বাড়িতে কোনও পরিবেশই ছিল না আধুনিক গাওয়ার। ক্ল্যাসিক্যালই ছিল প্রধান। আমার বাবা বলতেন, নোট টু নোট।'
জীবনের প্রথম অডিশনের কথা বলতে গিয়ে শিল্পী শেয়ার করেন এক মজার ঘটনা। বলেন, 'ছোট্ট আমি। কামিজ পরা। রেডিওর পর অডিশন দিই বিটিভিতে। তখন ডিআইটিতে বিটিভি। পাস করলাম। প্রথম হলাম। কার মধ্যে কী হলাম, এটা নিয়ে খবর ছিল না। শুধু খবর নিতাম, ভালো করছি কি না। এটুকু ছিল আমাদের চাহিদা। বিটিভির অনুষ্ঠান করতে হবে। অনুষ্ঠানের সময় ফ্রকের ওপর শাড়ি পরিয়ে দিলেন আমার বোনরা। নামকরা শিল্পীদের সঙ্গে সেদিন আমাকে সরাসরি গানের একটি অনুষ্ঠানে দাঁড়াতে হল। প্রথম দিনের প্রথম অনুষ্ঠান। তৎকালীন নামকরা শিল্পীদের মধ্যে শওকত আরা বেগম, সীমা খানসহ আরও কে কে যেন ছিলেন। সেদিন দাঁড়িয়ে সরাসরি গান গাইলাম। পরে শুনি টেলিভিশনে সরাসরি গানের সেই অনুষ্ঠান দেখে বাইক নিয়ে তাড়াহুড়া করে এলেন আজমল হুদা মিঠু।'
অডিশন দিয়ে সরাসরি সিনেমায়! নায়িকা হওয়া নিয়ে কেঁদে ভাসিয়েছিলেন। শিল্পী বলেন, 'সহকারী প্রযোজক ছিলেন মুসা আহমেদ। তাঁকে বলেছেন, আমি এক জায়গায় খেতে গিয়েছিলাম। মেয়েটাকে দেখে চলে এলাম। একটু মেয়েটার সঙ্গে কথা বলে দেখেন না, এই মেয়েটাকে আমার দরকার। মেয়েটাকে আমি ফিল্মে নায়িকা হিসেবে চাই।' আমি তো এত কিছু বুঝি না। মাথায় ঢুকছে, নায়িকারা খারাপ হয়। কী অদ্ভুত একটা মানসিকতা তখন। যেই মাত্র আমার কানে এল নায়িকা বানাতে চেয়েছে, এই যে কান্না, তা আর থামে না। নায়িকা হওয়ার প্রস্তাবে সাত দিন কেঁদেছিলাম। শুধু ভেবেছি, কেন? আমার মধ্যে কী খারাপটা পাওয়া গেল যে নায়িকা হওয়ার প্রস্তাব দিল? বাড়িতে এসব নিয়ে কথা হচ্ছিল।'
এরপরও পেয়েছিলেন নায়িকা হওয়ার অফার। সমরেশ মজুমদার নায়িকা হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সঙ্গে সেসময় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও ছিলেন। সমরেশ ও সুনীল আমাকে বলেছিলেন, 'আমরা কিন্তু রবীন্দ্রনাথের লেখা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অনেক কাজ করি। আপনি ওখানে কাজ করুন। আমি তখন বলেছিলাম, আপনারা নজরুল নিয়ে কিছু করুন, আমি সেখানে থাকব। মোটকথা, এ রকম নায়িকা হওয়ার প্রস্তাব অনেক ছিল। সব কটি উপেক্ষা করেছি।'
সংগীত শিল্পী নাহলে হতেন নৃত্যশিল্পী। খেলাধুলাও করতে পারতেন। সবশেষে এমনই জানালেন বার্থ ডে গার্ল।