শেষ আপডেট: 29th July 2024 14:39
অমল সরকার
বাংলাদেশ এখনও পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। গত মঙ্গলবার থেকে সীমিতভাবে ওয়াইফাই পরিষেবা ফেরানো হয়। রবিবার ইন্টারনেট ও মোবাইল পরিষেবা ফেরানো হয়েছে। তবে হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক ইত্যাদি সুবিধা আপাতত বন্ধ থাকছে। অফিসকাছারিও সীমিত সময়ের জন্য চালু হয়েছে। পালা করে কার্ফু বলবৎ থাকছে। সেনারা পুরোপুরি ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যায়নি। আশা করব, আর কিছুদিনের মধ্যে সব পরিষেবাই স্বাভাবিক হয়ে যাবে। উঠে যাবে কার্ফু, ব্যারাকে ফিরে যাবে সেনা।
তবে আমি আসলে এই স্বাভাবিক অবস্থা ফেরার কথা বলতে চাইছি না। আমি বলতে চাইছি বাংলাদেশের ফের ঘুরে দাঁড়ানোর কথা। সে দেশের মিডিয়ায় উঠে আসা ঢাকা, চট্টগ্রাম-সহ বড় বড় শহরগুলিতে ধ্বংসের ছবিগুলির সঙ্গে ৫৪ বছর আগে যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে আলাদে করা কঠিন। যুদ্ধে পরাজয় নিশ্চিত বুঝে পাক হানাদার বাহিনী দেশে ফিরে যাওয়ার আগে পূর্ব পাকিস্তানের অবশিষ্ট অবকাঠামো—রাস্তা, সেতু, রেলপথ, রেল স্টেশন, খাবারের গুদাম, বিদ্যুৎ কেন্দ্র ইত্যাদি ধ্বংস করে দিয়ে গিয়েছিল। জুলফিকার আলি ভুট্টো, ইয়াহিয়া খানেরা চেয়েছিল, স্বাধীন বাংলাদেশ যেন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। বাঙালিকে নিকেশ করতে পাকিস্তানিরা পড়ে সেই ভাবনা থেকেই যুদ্ধে শুরুর পয়লা দিনে তারা ঢাকা-সহ একাধিক শহরে এক রাতে (২৫ মার্চ, ১৯৭১) কয়েক ঘণ্টার মধ্যে দশ হাজারের বেশি ছাত্র-যুব-শিক্ষক-লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছিল বাঙালিকে মেধা শূন্য করে দিতে। সেই ধ্বংসলীলার সাদা-কালো ছবিগুলি কয়েক বছর আগে ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে দেখার সুযোগ হয়েছিল। সেগুলিরই যেন রঙিন সংস্করণ দেখছি গত কয়েকদিন যাবত। ৫৪ বছর আদে সদ্য ভূমিষ্ট দেশটিকে মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব হেনরি কিসিঞ্জার উপহাস করে বলেছিলেন, ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’।
২০২১-এ সেখ মুজিবের দেশের ৫০ বছর পূর্তি উদযাপনের সময় দেখা গেল পাকিস্তানকে অনেক পিছনে ফেলে মাথা উঁচু করে এগিয়ে গিয়েছে বাংলাদেশ। উন্নয়নের বিশ্ব স্বীকৃত মানদণ্ডগুলির অনেকগুলিতে ভারতকেও ছাপিয়ে গিয়েছে প্রতিবেশী ছোট দেশটি, আমরা যে দেশের স্বাধীনতার প্রসব-যন্ত্রণা লাঘবে ধাইমার ভূমিকা পালন করেছিলাম।
কোনও দেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তিকে যদি রক্তের দাম দিয়ে মাপা হয়, তাহলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অর্থ মূল্য সবচেয়ে বেশি। দুর্ভাগ্যের হল তিরিশ লাখ বাঙালির আত্মবলিদান, কোটি কোটি মানুষের লড়াইয়ে অর্জিত স্বাধীনতার সুখ-কাল স্থায়ী হয়নি। যুদ্ধ বিধ্বস্ত প্রিয় জন্মভূমিকে সাজিয়ে গুছিয়ে তোলার আগেই মাত্র চার বছরের মাথায় না ফেরার দেশে চলে যান বঙ্গবন্ধু। পরবর্তী দু-আড়াই দশকের ঘটনাবলী থেকে স্পষ্ট, শেখ মুজিবুরকে সপরিবার হত্যার দিনেই তাঁর প্রিয় বাংলাদেশ ফের পরাধীন হয়ে গিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধ শক্তির ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে।
স্বজাতির হাতে স্বাধীনতার স্থপতির সপরিবার মর্মাম্তির হত্যার অভিঘাত তো আছেই, বিগত অর্ধ দশকে সে দেশের মানুষ বারে বারে নজিরবিহীন ধ্বংস সৃষ্টিকারী ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়েছে, কখনও বন্যার জলে ডুবে থেকেছে দেশের সিংহভাগ এলাকা। সেই সঙ্গে আছে বারে বারে মিলিটারির ক্ষমতা দখলের চেষ্টা। দুই সেনা সর্বাধিনায়কের দীর্ঘ শাসন ছাড়াও সাম্প্রদায়িক ও স্বাধীনতার বিরুদ্ধ শক্তির সঙ্গে আপোসকামীদের ক্ষমতা দখল বাংলাদেশকে অনেকটাই পিছনের দিকে ঠেলে নিয়ে গিয়েছিল।
সেই জায়গা থেকে অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছিল পড়শি দেশটি। সেই কাজে তুলনামূলকভাবে অনেকটাই বেশি অবদান আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার, যাঁর বিরুদ্ধে দেশে স্বেরাচারি শাসন কায়েমের অভিযোগে পথে নামেন বহু মানুষ।
কোনও সন্দেহ নেই পুলিশ আরও পেশাদারিত্ব এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিলে অনেকগুলি মৃত্যু এড়ানো যেত। রংপুরে উত্তাল আন্দোলনে বছর পচিশের যে ছেলেটি পুলিশের বন্দুরের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়াল, নিরস্ত্র সেই যুবাকে দমাতে গুলিই কি অনিবার্য ছিল? তা না হয়ে থাকলে পুলিশের কঠোর সাজা ছাড়া শান্তি ফেরানো কঠিন। যদি সরকারি শাসন-প্রশাসনে অনাস্থাই বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াকে অমন মরণজয়ী প্রতিবাদী করে তুলে থাকে, তাহলে প্রশাসনের খোলনলচে বদলও অনিবার্য। সেই সঙ্গে তাঁর স্মৃতির প্রতি অসীম শ্রদ্ধা রেখে বলি, এ প্রশ্নেরও উত্তর অনুসন্ধান জরুরি, মৃত্যুকে জয় করার এমন সাহস তাঁর সহজাত, নাকি, কোনও মতাদর্শবাদীরা ওই পথ বেছে নিতে তাঁকে একটু একটু করে তৈরি করেছিল।
আন্দোলনে হিংসা, ধ্বংসের ছবি থেকে এখন আর কারও বুঝতে বাকি নেই, কোটা বিরোধী প্রতিবাদী ছাত্রদের ভিড়ে সরকার বিরোধী পাকা মাথার বুড়োরাও ছিল। ধ্বংসযজ্ঞের পর হাসিনা সরকার সেই অভিযোগ তুলতেও তাঁর প্রশাসন কেন তা আগাম আঁচ করতে পারল না তারও কারণ সন্ধান জরুরি। বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের বিচার্য বিষয়ের তালিকায় এই বিষয়কে আড়াল করা হবে ভবিষ্যতের জন্য বিপদকে সুরক্ষিত করা।
আসলে বাংলাদেশে প্রশাসন থেকে শাসক দল, সর্বত্র যেমন দুর্নীতি, দাদাগিরি, জমিদারি ফলানোর প্রবণতা বেড়েছে, সেই সঙ্গে প্রবলভাবে অনুপ্রবেশ ঘটেছে জামাত, হেফাজতের মতো উগ্র মৌলবাদী শক্তির। অপারের বন্ধুদের মুখে জানলাম, যে ছাত্র লিগকে কোটা বিরোধী আন্দোলনকারীদের মোকাবিলায় নামানো হয়েছিল তাদের মধ্যে জামাত, হেফাজতের মতাদর্শে জারিত বহু সমর্থক প্রতিবাদীদের মধ্যে মিশে ছিল।
আওয়ামী লিগ ও তাদের অঙ্গ সংগঠনে মৌলবাদী শক্তির অনুপ্রবেশ এখন আর গোপন কথাটি নয়। দুর্ভাগ্যের হল, শুধু শাসক দলই নয়, বাংলাদেশে ক্রমে ক্ষয়িষ্ণু বাম দলগুলি, যারা প্রগতিশীল রাজনীতির ধারা বহন করে চলছিল তাদের মধ্যেও মৌলবাদী মতাদর্শ মাথাচাড়া দিয়েছে। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদের দুর্বল হওয়াও সামগ্রিক সংকটকে আরও তীব্র করে তুলেছে। অন্যদিকে, তীব্র সংকট সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে। ফলে পদে পদে বিপন্ন ধর্মনিরপেক্ষতা-সহ মুক্তিযুদ্ধের মহান চেতনা বাঙালি জাতিস্বত্তা।
অপারে বাংলা ভাষা, কৃষ্টি, নাটক-সহ সংস্কৃতির নানাবিধি অঙ্গনে চর্চায় ভাটা, সংকট কাঁটাতারের এপারেও বড় অভিঘাত হয়ে দেখা দিচ্ছে। দেশ থেকে দেশান্তরে মৌলবাদীদের আত্মীয়তাই বিশ্বায়নের সর্ববৃহৎ দৃষ্টান্ত। নানা ঘটনায় দুই বাংলার, দুই দেশের মৌলবাদীদের পিরিতি প্রকাশ্যে এসেছে। ফলে বাংলাদেশের চলমান আন্দোলন ও সংহিসার ঘটনায় ছাত্রদের রক্ত ঝরা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশের পাশাপাশি আন্দোলনের চরিত্র এবং কারিগরদের সম্পর্কেও এপারের সতর্কতা জরুরি।
হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে আম-বাংলাদেশির ক্ষোভের কারণ অজানা নয়। দুর্নীতি, জিনিসপত্রের আকাশছোঁয়া দাম তো আছেই, দেশটির প্রধান দুভাগ্য হল পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশেও জমানা নির্বিশেষে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ। যদিও হাসিনা সরকারের সময়ে নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করার অভিযোগ তোলা হলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে দুই সেনা শাসক জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মহম্মদ এরশাদের শাসনামলে ভোট কীভাবে নির্বাচন কমিশের নোটিসে সীমাবদ্ধ ছিল। এ বছর জানুযারির জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে উত্থাপিত প্রশ্নকে মান্যতা দিয়েও বলতে হয়, অতীতে কোনও নির্বাচন এবারে মতো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয়নি।
সমস্যা হল, বিরোধী দল বিএনপি ও তাদের সহযোগী দলগুলির লাগাতার ভোট বয়কটের সিদ্ধান্ত সরকার বিরোধী এক বিপুল জনগোষ্ঠীকে নেতৃত্বহীন করে তুলেছে, যাদের অপকর্মের দায় বিরোধীরা নিচ্ছে না, কিন্তু ধ্বংসাত্মক আন্দোলনে হাততালি দিচ্ছে।
অন্যদিকে, আমেরিকা-সহ পশ্চিম মুলুকে অনাবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে আওয়ামী লিগ বিরোধীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় পান থেকে চুন খসলেই হাসিনা সরকারের উপরে খড়্গহস্ত ওই সব দেশ ও সেখানকার শাসক দল। যেমন বাইডেন প্রশাসন। গণতন্ত্র রক্ষার বুলি মুখে তারা আসলে অনাবাসী বাংলাদেশিদের ভোট নিজেদের বাক্সে টানতে উদগ্রীব।
আসলে গণতন্ত্র, মানবাধিকার পুনরুদ্ধার করোনা কিংবা কলেরার টিকা নয়, যে নিলেই রোগটা হবে না। যে দেশে সব নির্বাচনই প্রশ্নবিদ্ধ, দেশের স্থপতিকে নিজেরই দেশের সেনার হাতে নিহত হতে হয়, দীর্ঘ সময় দেশ সেনা শাসনাধীনে ছিল এবং বাড়ে বাড়ে ক্যান্টনমেন্টের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিহত করার চেষ্টা হয়েছে, সে দেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার পুনরুদ্ধারে পঁঞ্চাশ-পঁঞ্চান্ন বছরকে যথেষ্ট বলা যায় না। দায় শুধু আজকের শাসকের নয়, সকলের।
তারপরও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে ক্ষমতায় এলেও হাসিনা দেশকে টেনে তোলার চেষ্টা করছিলেন। এমন কিছু অবকাঠামো নির্মাণ করেছেন যা তাঁর পূর্বসূরিরা কল্পনাও করেননি। পদ্মা সেতুর নির্মাণ শৈলির থেকেও বড় বিস্ময় এমন একটি প্রকল্পের ভাবনা এবং নিজের টাকায় তা বাস্তবায়নের সাহস। শেখ হাসিনার শাসনকালেই যাত্রা শুরু করেছে ঢাকার মেট্রো রেল, চট্টগ্রামে কর্ণফুলি নদীর তলদেশে এশিয়ার প্রথম আন্ডারপাস, ঢাকায় মেট্রো, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে।