শেষ আপডেট: 7th February 2025 19:45
অমল সরকার
‘শেখ হাসিনা যদি কোনওদিন পাবলিক অ্যাড্রেস করে—অ্যান্টি ফ্যাসিস্টদের সরাসরি ঘোষণা দেওয়া উচিত যে আমরা টুঙ্গিপাড়া কবরসৌধ বুলডোজ করে পুরাপুরি মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেব।’
৫ ফেব্রুয়ারি প্রথমবার শেখ হাসিনা আওয়ামী লিগের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার আগেই ফেসবুকে এই কথা লিখেছিলেন ফাহাম আবদুস সালাম। কে তিনি, যার কথা প্রায় অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল বলা চলে! টুঙ্গিপাড়ায় শেখ মুজিবুর রহমানের করবসৌধ ভাঙা না হলেও তাঁর ঢাকার ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাড়িটির নব্বুই ভাগ ধূলিসাৎ করা হয়েছে। নিছক ব্যক্তি শেখ মুজিবের বসতভিটা বলেই নয়, ইতিহাসের সরণিতে নানা পর্ব ছুঁয়েছিল বাংলাদেশের ওই বাড়িটির গায়ে। মুজিবকে, মুজিবের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডকে কেউ উপেক্ষা করতেই পারেন, কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই, পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীকারের দাবিতে আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের সঙ্গে জুড়ে আছে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িটি। বলা চলে ৩২, ধানমন্ডি ছিল ইট-কাঠ-পাথরে বাঙালির পরিচয় স্বত্ত্বা।
ফাহাম আবদুস সালামের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। এই কৃতী বাংলাদেশি পেশায় একজন চিকিৎসা বিজ্ঞানী। এছাড়া লেখক এবং তথ্যচিত্র নির্মাতা। ২০০৪ থেকে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী মাঝবয়সি ফাহাম আবদুস সালামের আরও এক পরিচয় তিনি বাংলাদেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি বা বিএনপি-র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মেয়ে-জামাই। যতদূর জানি, আলমগীর বাংলাদেশের কতিপয় সজ্জন রাজনীতিকদের অন্যতম। বিএনপি-র মহাসচিব হিসাবে তিনি যে রাজনৈতিক ক্ষমতা ধরেন, তা তাঁর আচার-আচরণে তেমন প্রকাশ পায় না। আবার একথাও ঠিক, নিজগুণে কৃতী ফাহাম আবদুস সালামের পোস্টটি নিয়ে আলোচনার একটি বিশেষ কারণ মির্জা ফখরুল তাঁর শ্বশুর।
গত বছর ৫ অগাস্ট গণঅভ্যুত্থানের পরও শেখ মুজিবের ধানমন্ডির বাড়িতে হামলা হয়েছিল। তখনও তাঁর বহু মূর্তি ও ম্যুরাল ভাঙা হয়। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তখন ওই সব ঘটনায় তাঁর খারাপ লাগার কথা একাধিক ভাষণে উল্লেখ করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিব স্বাধীনতার যুদ্ধের অগ্রণী নেতা ছিলেন। তাঁর মূর্তি ভাঙা হলে খারাপ লাগে।’
সেই মির্জা ফখরুল ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িটির উপর হামলার নিন্দা করেননি। বিচিত্র অবস্থান নিয়েছে বিএনপি নেতৃত্ব। শুক্রবার ভোর রাতে সমাজমাধ্যমে দলের প্রবীণ নেতা রুহুল কবীর রিজভীর নামে একটি বিবৃতি প্রচার করা হয়েছে। তাতে মুজিবের বাড়ি ভাঙার ঘটনার নিন্দাসূচক একটি বাক্য দূরে থাক, শব্দ পর্যন্ত নেই। সেটি কেউ চোখ বুজে শুনলে মনে হবে আগের দিন অর্থাৎ বৃহস্পতিবার বিকালে মহম্মদ ইউনুসের অন্তর্বর্তী সরকারের বিবৃতিটিই পাঠ করা হচ্ছে। সরকারের সুরেই খালেদা জিয়া, তারেক জিয়ার দল গোটা পরিস্থিতির জন্য শেখ হাসিনাকে দায়ী করেছেন।
আমার মনে হয়, গণঅভ্যুত্থানের ছয় মাসের মাথায় বিএনপি মুজিবের ঐতিহাসিক বাড়ি ভাঙার ইস্যুতে তাদের বিগত ছয়মাসের পথ থেকে সরে গেল। তারা আওয়ামী লিগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা, হাসিনা নিয়োজিত রাষ্ট্রপতির অপসারণ এবং শেখ মুজিবের চালু করা সংবিধান পুরোপুরি বাতিলের সরকারি প্রস্তাবে সায় দেয়নি। বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিচার করে আমার মনে হয়েছিল, এই মুহূর্তে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত দুই দল আওয়ামী লিগ ও বিএনপি-র হাত ধরাধরি করে চলা উচিত। কিন্তু মুজিবের বাড়ি ভাঙার ইস্যুতে বিএনপির অবস্থানে স্পষ্ট তারা এই রাজনৈতিক সম্প্রীতি চায় না।
আমার মতে, বিএনপি-র এই অবস্থান একটি ‘ঐতিহাসিক ভুল’। হিংসা প্রতিহিংসার জন্ম দেয়। বিএনপি যে নতুন বাংলাদেশ্র কথা বলছে সেখানে বদলার রাজনীতির অবসান চেয়ে দলটি কঠোর অবস্থান নিলেই বরং ভাল করত বলে আমার মনে হয়। মনে রাখা দরকার আওয়ামী লিগ ও বিএনপি—দুই দলেরই প্রতিষ্ঠাতা নেতাকে বড় নির্মমভাবে মরতে হয়েছে। মৃত্যু পরবর্তী প্রাপ্য মর্যাদাটুকুও জোটেনি তাঁদের। অথচ মৃত্যুকালে দু’জনেই ছিলেন রাষ্ট্রপতি।
১৯৭৫-এর ১৫ অগাস্ট সকালে শেখ মুজিবকে হত্যার পর দুপুর পর্যন্ত তাঁর দেহ ধানমন্ডির ওই বাড়ির সিঁড়িতে পরে ছিল। অতি অনাদরে সেনা কপ্টারে দেহ টুঙ্গিপাড়ায় নিয়ে গিয়ে তাড়াহুড়ো করে কবর দেওয়া হয়েছিল। সেদিনের সেনা কর্তারা হয়তো ভাবতে পারেননি মুজিবের মেয়ে একদিন দলের হাল ধরবেন, দেশের ভার নেবেন এবং বাবার কবরকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সাজিয়ে তুলবেন যা ক্রমে বাংলাদেশের বহু মানুষের তীর্থভূমির মতো গন্তব্য হয়ে উঠবে। টুঙ্গিপাড়ায় মুজিবের কবরে শ্রদ্ধা জানাতে প্রতিদিন শত শত মানুষ ভিড় করেন।
অন্যদিকে, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি থাকাকালে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে খুন হন। মুজিবের মতো তাঁর হত্যাকারীরাও ছিল সেনা সদস্য। হত্যার পর পার্বত্য চট্টগ্রামের এক জঙ্গল ঘেরা প্রত্যন্ত গ্রামে জিয়ার গুলিবিদ্ধ দেহ মাটি চাপা দিয়েছিল সেনারা। গ্রামবাসীরা সেনাবাহিনী দেখে কাছে যায়নি। জানতেও পারেনি মাটি চাপা দেহটি দেশের রাষ্ট্রপতির।
গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে স্থাপনা ভাঙার যে রাজনীতি শুরু হয়েছে তার অভিঘাতের প্রভাব কতদূর গড়াবে আজই বলা কঠিন। তবে সব দলই এই কথাটি মনে রাখলে ভাল করবে, তাদের নেতাদের, দলীয় প্রতিষ্ঠাতাদের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িঘর, কবরসৌধ আছে। আছে স্মৃতিবিজড়িত আরও স্থাপনা। বিএনপি কিন্তু সরকারিভাবে স্পষ্ট করেছে, তারা মুজিবের বাড়ি ভাঙার ঘটনায় অনুতপ্ত নয়। হয়তো এই নিয়ে বিতর্ক, চর্চা এড়াতেই তারা বিচিত্র পদক্ষেপ করেছে মাঝরাতে বিবৃতি দিয়ে।
প্রশ্ন হল, গণঅভ্যুত্থান এবং অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাসের মাথায় বিএনপি কেন মহম্মদ ইউনুসের সঙ্গে আপসের রাস্তায় হাঁটল। এর পিছনে দু-তিনটি কারণ আমার মনে হয়েছে; সেগুলি এক-দুই করে পেশ করছি। এক. বাংলাদেশের ভোটের ময়দান তিনটি শিবিরে বিভক্ত। একটি আওয়ামী লিগ, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও চেতনা যাদের প্রধান রাজনৈতিক ভিত। দ্বিতীয় পক্ষ বিএনপি, যে দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডা ছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লিগ ও শেখ মুজিবের মতো বাংলা ভাষা এবং স্বশাসন থেকে স্বাধীনতার লড়াইয়ের উজ্জ্বল ইতিহাসের ধারক নয়। ফলে মুক্তিযুদ্ধ তাদের প্রধান ভিত্তি নয়। জিয়াউর রহমান যে রাজনীতি তুলে ধরতেন তা ছিল, তিনি দেশের কর্ণধার হওয়ার পর নতুন বাংলাদেশে জন্ম হয়েছে। তিনি তাই বাঙালি জাতীয়তাবাদের জায়গায় বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কথা বলতেন। বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে তৃতীয় শক্তি জামায়াতে ইসলামি-সহ ইসলামিক দলগুলির ভোট। এই পক্ষের প্রধান শক্তি জামাত স্বাধীনতার যুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। স্বাধীন বাংলাদেশ তারা চায়নি। আমার ধারণা, মুজিবের বাড়ি ভাঙার ঘটনার নিন্দা না করে বিএনপি জামাত-সহ মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ভোটারদের বার্তা দিল। তাদের কাছে টানার চেষ্টা করল। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে আওয়ামী লিগ বিরোধী ভোটারের মেরুকরণের পথে হাঁটল বিএনপি। অতীতের মতো তারা জামায়াতের হাত ধরবে কিনা এখনই বলা কঠিন।
দুই. ইউনুস দিন কয়েক আগে নিরাপত্তা বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করতে। সবাই জানে আওয়ামী লিগ সেভাবে ময়দানে নেই। ফলে চাঁদাবাজিতে এক নম্বরে এখন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। আমার কাছে খবর পুলিশ বিএনপির চাঁদাবাজদের থানাভিত্তিক তালিকা তৈরি করেছে। মুজিবের বাড়ি ভাঙার মতো বড় ঘটনায় চোখ বুজে থাকতে ইউনুসের বিএনপি-কে পাশে দরকার ছিল। কারণ তিনি জানেন দেশে তো বটেই, বিদেশেও এই ঘটনার জন্য বড় ধাক্কা সামলাতে হবে তাঁকে। এখন সেই কাজটা সরকারের হয়ে বিএনপি করবে যাদের আন্তর্জাতিক অঙ্গন যথেষ্ট মজবুত। ইউরোপ, আমেরিকা থেকে আরব বিশ্ব, সর্বত্র বিএনপির সমর্থক সুশীল সমাজের লোকেরা আছেন। শেখ হাসিনার মতো খালেদা জিয়া, তারেক জিয়ার দলেরও বিদেশের শাখা বেশ সক্রিয়।
তিন. তারেক জিয়ার দেশে ফেরার ইস্যু। বিএনপি-কে খেলানোর এই বড় তাসটি অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে আছে। তারা সবুজ সংকেত না দিলে বিএনপির কার্যনির্বাহী চেয়ারপারসন দেশে ফিরতে পারবেন না। ফলে প্রকাশ্যে ইউনুস সরকারের সমালোচনা, দ্রুত নির্বাচন চেয়ে বায়নাক্কা করলেও বিএনপি-র তারেকের দেশে ফেরা পর্যন্ত ইউনুসের সঙ্গে আপস না করে উপায় নেই। আবারও বলি, এই বোঝাপড়া, বিশেষ করে মুজিবের বাড়ি ভাঙার ঘটনার নিন্দা না করা বিএনপির ঐতিহাসিক ভুল।