শেষ আপডেট: 13th August 2024 16:48
বাংলাদেশে সদ্য ঘটে যাওয়া পালাবদলের পর অন্তবর্তী সরকার দেশ চালনার দায়িত্ব নিয়েছে। কীভাবে এই পালাবদল সম্ভব হল? তাতে বিএনপি-র কি কোনও কৃতিত্ব আছে? অন্তবর্তী সরকারকে তারা কতদিন ক্ষমতায় থাকতে দিতে আগ্রহী? ভারতে আশ্রয় নেওয়া শেখ হাসিনা সম্পর্কে তাঁদের অবস্থান কী? হাসিনা বিহীন বাংলাদেশে আওয়ামী লিগের পরিণতি কী হতে পারে? কোনও পথে এগবে বিএনপি? দ্য ওয়াল-কে ঢাকা থেকে টেলিফোনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বললেন বাংলাদেশের ‘ভদ্রলোক রাজনীতিক’ বিএনপি-র শীর্ষ নেতা মঈন খান। তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন ‘দ্য ওয়াল’-এর এক্সিকিউটিভ এডিটর অমল সরকার।
দ্য ওয়াল: শেখ হাসিনার শাসনের অবসান হয়েছে। তিনি দেশ থেকে ভারতে চলে এসেছেন। এখন বাংলাদেশে আপনারা কেমন আছেন?
মঈন খান: এক কথায় বলা চলে মুক্ত বাতাস উপভোগ করছেন বাংলাদেশের মানুষ। এই অনুভূতিটা একজন বাংলাদেশির চাইতে আর কেউ বেশি অনুভব করতে পারবেন না। স্বাধীনতার আগে আমরা বুঝেছিলাম, পাকিস্তানের কাঠানোর মধ্যে গণতন্ত্র সম্ভব না। তাই স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিল এ দেশের মানুষ। সেই দেশে গত পনেরো বছর গণতন্ত্র বলতে কিছু ছিল না।
দ্য ওয়াল: হাসিনার এমন পরিণতি কেন হল বলে আপনার মনে হয়?
মঈন খান: বাঙালি এমন একটা জাতি যে তাদের যদি দুটি অপশন দেওয়া হয়, এক. পর্যাপ্ত ভালমন্দ খেতে দেওয়া হবে, কিন্তু মুখ বন্ধ রাখতে হবে। দুই. মন খুলে কথা বলতে দেওয়া হবে, তবে খাবার মিলবে না, তাহলে প্রায় শতভাগ বাঙালি দ্বিতীয় অপশনটা বেছে নেবেন। বাক্ স্বাধীনতার সঙ্গে তারা আপস করবে না। আপনি দেখুন বাঙালি মোঘলদের কাছে বশ্যতা স্বীকার করেনি, ব্রিটিশদের কাছে করেনি। বারে বারে বিদ্রোহ করেছে। তাদের রক্তে বিদ্রোহ। সেটা চিরম্তন সত্য। সেই জাতিকে পনেরো বছর ধরে দাবিয়ে রাখা হয়েছিল।
দ্য ওয়াল: সংবাদমাধ্যমের খবর, প্রধান উপদেষ্টা মহম্মদ ইউনুস সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দানবের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এই ব্যাপারে আপনি কী বলেন?
মঈন খান: আমি ব্যক্তিগতভাবে কারও সম্পর্কে কিছু বলতে চাই না। কখনও বলি না। তবে একথা ঠিক, গত পনেরো বছরে দেশটা কলুষিত হয়ে গিয়েছিল। সেটা থেকে ছাত্র-জনতার আন্দোলন আমাদের মুক্তি দিয়েছে।
দ্য ওয়াল: মানুষ তো বলছে হাসিনাকে বিএনপি সরাতে পারেনি। ছাত্র-জনতা তা পেরেছে। বিএনপি পারল না কেন?
মঈন খান: বাস্তব পরিস্থিতির বিচারে বললে ছাত্র-জনতার বিশাল কৃতিত্ব অস্বীকার করার নয়। আমি সে জন্য তাদের অভিনন্দন জানাই। সেই সঙ্গে একথাও বলব, সাম্প্রতিক পট-পরিবর্তনে বিএনপি-র ভূমিকা বিচার-বিশ্লেষণের দাবি রাখে। ছাত্র-জনতার আন্দোলন স্ফুলিঙ্গের কাজ করেছে ঠিকই। কিন্তু হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভের বারুদ বিএনপি-সহ গণতান্ত্রিক দলগুলির বিগত ১৫ বছরের আন্দোলনের ফলেই মানুষের মনে জমা হয়েছিল। এটা মানি, আমরা রাজনৈতিক দলগুলি ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশের দরজা মানুষের সামনে খুলে দিতে পারিনি। সেটা ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সম্ভব হয়েছে।
দ্য ওয়াল ব্যুরো: ছাত্ররা কেন এবং কীভাবে সফল হল?
মঈন খান: মানুষের ক্ষোভ তো ছিলই। সেই সঙ্গে সরকারের ভুল। লক্ষ্য করে দেখুন, আন্দোলনটা অল্প সময়ের হলেও তাতে তিনটি ধাপ ছিল। প্রথম ধাপ. কোটা বিরোধী আন্দোলন। দ্বিতীয় ধাপ. ১৮ জুলাই আন্দোলনকারীদের উপর নির্বিচারে গুলি বর্ষণ, নিরীহ ছাত্র, এমনকী নাবালকও বাদ গেল না। তখন দাবি উঠল স্বরাষ্ট্র, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের পদত্যাগ করতে হবে। তৃতীয় ধাপ. গোয়েন্দা পুলিশ প্রধান সমন্বয়কদের তুলে নিয়ে গিয়ে জোর করে আপসের খসড়ায় সই করালো। ছাত্ররা পুলিশের হেফাজত থেকে ফিরে প্রধানমন্ত্রীকে অপসারণের একদফা দাবি তুললেন। তার জেরে ৫ অগাস্টের বিস্ফোরণ। বোমা-বারুদের বিস্ফোরণ নয়, জনতার গর্জন শুনল গণভবন এবং গোটা দেশ।
দ্য ওয়াল: হাসিনার দেশ ছেড়ে যাওয়াকে আপনি কীভাবে দেখেন?
মঈন খান: দেশের জন্য লজ্জার। হাসিনা নিজের এবং দলেরও চূড়ান্ত ক্ষতি করেছেন পালিয়ে গিয়ে। স্বৈরশাসক এরশাদও আন্দোলনের মুখে দেশ ছেড়ে পালাননি। তিনি জেলে গিয়েছেন। আবার রাজনীতিতে ফিরে এসেছিলেন। অন্যদিকে, হাসিনা তাঁর নিজের দলের সঙ্গেই বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। একথা আমি বিএনপি নেতা হিসাবে বলছি তা কিন্তু নয়। কান পাতলে শোনা যাচ্ছে আওয়ামী লিগের নেতা-কর্মীরাও বলছেন।
আসলে হাসিনা শেষ দিকে আর দলকে সামনে রেখে রাজনীতি করছিলেন না। তিনি রাজনীতি করছিলেন পুলিশ, র্যাব, বিচার বিভাগ, আমলাদের দিয়ে। তিনি দলকেই একঘরে করে দিয়েছিলেন।
দ্য ওয়াল: অনেকেই বলছেন আওয়ামী লিগ হঠাৎ করেই নিঃশেষ হয়ে গেল। আপনি কী বলেন।
মঈন খান: হঠাৎ করে কিছু হয়নি। গত পনেরো বছর ধরে হয়েছে। ক্ষমতায় থাকতে তারা স্বৈরশাসকের (পড়ুন সাবেক সেনা প্রধান ও রাষ্ট্রপতি হুসেন মহম্মদ এরশাদ) সঙ্গে আপস করেছে। সরকার এবং দল একসঙ্গে আনপপুলার হয়েছে। হাসিনা স্তাবক পরিবৃত হয়ে পড়েছিলেন। হাসিনা তাঁদের দিয়ে একটা মিথ্যার স্বর্গ নির্মাণ করিয়েছিলেন। যেমনটা হিটলারের প্রচারমন্ত্রী গোয়েবলস করেছিলেন। হিটলার তাঁর প্রশংসা করতে গিয়ে গোয়েবলসকে একবার পরামর্শ দিয়েছিলেন, তুমি নিজে কিন্তু কখনও এই প্রচারে বিগলিত হয়ে যেও না। ঘটনা হল, সেই ভুলটা গোয়েবলস না করলেও শেখ হাসিনা করেছেন। তিনি নিজেই নিজের তৈরি মিথ্যার স্বর্গকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন।
দ্য ওয়াল: আপনারা প্রথমে তিনমাসের মধ্যে নির্বাচন দাবি করেছিলেন। কিন্তু বিএনপি প্রধান উপদেষ্টাকে কথা দিয়েছে তারা অন্তর্বর্তী সরকারকে পর্যাপ্ত সময় দিতে চায়। এই সময়কালটা কতদিনের?
মঈন খান: আমাদের সংবিধানে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান ছিল যা শেখ হাসিনা তুলে দিয়েছেন। সেই সরকারের মেয়াদ বলা ছিল ৯০দিন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিধান সংবিধানে নেই। ফলে সময়সীমা বেঁধে দেওয়ারও সুযোগ নেই। তাছাড়া অপশাসনের যে জঞ্জাল পরিষ্কার করা দরকার তারজন্য সময় তো লাগবেই। বলতে পারেন ডকট্রিন অফ নেসিসিটি-তে আমরা পরে গেছি। প্রয়োজনীয় সময় তো দিতে হবে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে রূপান্তরের কথা বলা হয়েছিল। সংস্কারের কথা বলা হয়েছিল। তাই জোর করে আমরা শর্ত চাপিয়ে দিতে চাই না। তবে একথাও বলব, পূর্ণাঙ্গ সংস্কার না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন বন্ধ রাখাও আমি যুক্তিযুক্ত মনে করি না। ভোটের পরও সংস্কার হতে পারে।
দ্য ওয়াল: ছাত্রদের দাবি মেনে প্রধান বিচারপতিকে সরে যেতে হয়েছে। আপনারা কি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী রাষ্ট্রপতিকেও সরাতে চান। নির্বাচন কমিশনারদের বিষয়ে কী ভাবছেন?
মঈন খান: ভারতের মতো বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিও ক্ষমতাহীন। ক্ষমতা সব প্রধানমন্ত্রীর হাতে। রাষ্ট্রপতির অপসারণ তাই এই মুহূর্তে আমাদের এজেন্ডায় নেই। তবে নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশনে পরিবর্তন দরকার। বর্তমান নির্বাচন কমিশন পরিচালিত ভোটে তৈরি জাতীয় সংসদ ভেঙ দেওয়া হয়েছে। স্বশাসিত সংস্থার পরিচালকেরা নিজে থেকে সরে গেলে ভাল।
দ্য ওয়াল: বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনেই তো জেলা ও উপজেলা পরিষদের ভোট হয়েছে। সেগুলির তবে ভবিষ্যৎ কী?
মঈন খান: সেগুলিও ভেঙে দিয়ে নতুন করে নির্বাচন করানো দরকার। সব ভুয়া সদস্য সেগুলি দখল করে আছে। কোনও ভোট হয়নি। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পাঁচ শতাংশ ভোটও পড়েনি। কারণ, আওয়ামী লিগের লোকেরাও রাগে-ক্ষোভে ভোট দিতে যায়নি। তারাও জানত কোন আসনে কী ফল হবে। আসলে ভোটারকেই হাসিনা সবচেয়ে বেশি ভয় পেয়েছেন বারে বারে।
দ্য ওয়াল: আপনারা কি সরকারের কাছে দাবি জানাবেন হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে বিচার করা হোক।
মঈন খান: সরকার কী করবে সরকারের বিষয়। কিন্তু বিচার তো করতেই হবে। যেভাবে নিরীহ মানুষ, ছাত্র, শিশুকে হত্যা করা হয়েছে, বাংলাদেশ তো দূরে থাক, গোটা পৃথিবীতে এমন নৃশংসতার নজির নেই। শেখ হাসিনা ইন্টারন্যাশনার ক্রামস ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিলেন। তাঁর তো উচিত নিজেকে বিচারের মুখোমুখি দাড় করানো।
দ্য ওয়াল: আওয়ামী লিগ নিষ্ক্রিয়। এদিকে আন্দোলনকারী ছাত্ররা রাজনৈতিক দল গড়ার কথা বলছে। ভোট হলে আপনাদের তো মনে হচ্ছে নতুন প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হতে হবে। এই বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
মঈন খান: রাজনৈতিক দল গড়ার অধিকার সকলের আছে। ছাত্ররা যদি দল গড়ে, মানুষ যদি তাদের বেছে নেয় তো আপত্তি করার কিছু নেই। শুধু একটি কথা বলব, ছাত্ররা যেন পড়াশুনোটা পুরোপুরি শেষ করে তারপর রাজনীতিতে আসে। রাজনীতি একটা প্রক্রিয়া। সেটা যেন অনুসরণ করে।
দ্য ওয়াল: হাসিনা দেশ ছাড়ার পর বাংলাদেশে চলমান হিংসায় সংখ্যালঘুদের বিশেষভাবে নিশানা করা হয়েছে। এটা কেন হল? সংখ্যালঘুরা কী অন্যায় করেছেন?
মঈন খান: আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, স্বার্থান্বেষী কিছ মানুষ এই ব্যাপারে অপপ্রচার চালাচ্ছে। বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছেন। অভিযোগ ধরে ধরে তদন্ত করলেও জানা যাবে, কীভাবে মিথ্যা ছড়ানো হয়েছে।
দ্য ওয়াল: ভারত বিরোধিতাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ভারতের উপর রাগ কেন?
মঈন খান: বাংলাদেশের মানুষ মোটেও ভারত বিরোধী নন। এটাও একটা অপপ্রচার। আসলে ভারতের বর্তমান শাসকেরা শুধু আওয়ামী লিগ সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেছিলেন। মানুষের এটায় আপত্তি ছিল। দুটি দেশের মধ্যেও মানুষকে বাদ দিয়ে কোনও সম্পর্ক হয় না। মানুষ সর্বাগ্রে।