শেষ আপডেট: 17th March 2025 11:31
দ্য ওয়াল ব্যুরো: বাংলাদেশের (Bangladesh) প্রধান উপদেষ্টা মহম্মদ ইউনুস (Md Yunus) আগামী ২৬ মার্চ চিন (China) সফরে যাবেন। ২৮ মার্চ বেজিংয়ে (Beijing) চিনের প্রেসিডেন্ট সি জিংপিনের (Xi Jinping) সঙ্গে ইউনূসের দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হবে। বেজিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষণ দেবেন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তাঁকে সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রি দেওয়া হবে। প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে চিনেই প্রথম দ্বিপাক্ষিক সফর করবেন ইউনুস।
২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে সপ্তাহব্যাপী সরকারি উদ্যোগে নানা অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। ইউনুস সকালের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে বিকালে চিন রওনা হয়ে যাবেন। তাঁকে নিয়ে যেতে বিশেষ বিমান পাঠাবে চিন।
স্বাধীনতা দিবসের রাতে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রীয় নৈশভোজের আয়োজন করেন। এবার রাষ্ট্রপতি ভবনে নৈশভোজের আয়োজন হবে কি না তা এখনও স্পষ্ট নয়। গত বছর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের নৈশ ভোজ হয়েছিল। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা তাতে অংশ নেননি। স্বাধীনতা দিবসে তাঁর বিদেশ যাত্রার সিদ্ধান্তে অনেকেই বিস্মিত। এমন সিদ্ধান্ত নজিরবিহীন, বলছে ওয়াকিবহাল মহল।
গত মাসে অন্যতম পার্টি বিএনপি ও তাদের সহযোগী দলের নেতাদের চিন সফরের ব্যবস্থা করেছিল ঢাকার চিনা দূতাবাস। মনে করা হচ্ছে, সফর নিয়ে ইউনুস যাতে দেশে প্রশ্নের মুখে না পড়েন সেই কারণেই আগে বিএনপি ও তাদের সহযোগী দলগুলির নেতাদের সফরের ব্যবস্থা করা হয়।
ইউনুসের ঘোষণা অনুযায়ী চলতি বছরের ডিসেম্বর অথবা আগামী বছরের মে-জুন মাসের মধ্যে বাংলাদেশে নির্বাচন হওয়ার কথা। তার আগে একটি অনির্বাচিত সরকারের প্রধানকে চিনের বিশেষ খাতির করা নিয়ে কূটনৈতিক মহলে চর্চা শুরু হয়েছে। অতিথির জন্য বিমান পাঠানোই শুধু নয়, ইউনুসের সফর সূচিতে বাংলাদেশে চিনা বিনিয়োগ বৃদ্ধির বিষয়ে বিশদ আলোচনার ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে। রবিবার ঢাকায় নিযুক্ত চিনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন প্রধান উপদেষ্টা ইউনুসের সঙ্গে দেখা করে সফরের খুঁটিনাটি নিয়ে কথা বলেন।
কূটনৈতিক মহলের মতে, ঢাকা-দিল্লি শীতল সম্পর্কের সুযোগ নিতেই বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করতে চাইছে চিন। শুধু বাণিজ্য বৃদ্ধি এবং পরিকাঠামোয় বিনিয়োগই নয়, ভূ-রাজনৈতিক কারণেও বাংলাদেশ চিনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে ভারতকে চাপে রাখতে বাংলাদেশের সঙ্গে মৈত্রী চিনের অগ্রাধিকার। কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, চিনের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্কের হাত ধরে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হবে। গোটা বিশ্বে পাকিস্তান হল চিনের সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু। স্বভাবতই বাংলাদেশের সঙ্গে চিন ও পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠতা ভারতের চিন্তার কারণ হতে পারে।
তাৎপর্যপূর্ণ হল, ইউনুস সরকারও চিনের ডাকে সাড়া দিতে অতি তৎপর। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বিবৃতির লড়াই অব্যাহত। এই পরিস্থিতিতে বিগত শেখ হাসিনা সরকারের সময়ের বিদেশ নীতি থেকে সরে যাচ্ছে বাংলাদেশ। হাসিনা জমানায় দিল্লি ও বেজিংয়ের মধ্যে সমদূরত্ব বজায় রেখে চলার নীতি নিয়েছিল ঢাকা। যদিও বহু ক্ষেত্রে দিল্লি ঘনিষ্ঠতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে বেশি। অন্যদিকে, পদ্মা সেতু, ঢাকায় মেট্রো রেল, চট্টগ্রামে নদীর তলদেশে পাতাল পথ নির্মাণের মতো বড় পরিকাঠামোয় চিন বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেছে।
ইউনুস সরকার এবার বাংলাদেশে শিল্প ক্ষেত্রে চিনের বিনিয়োগ চাইছে। সেই কারণে চিনা বণিকদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করার কথা ইউনুসের। তিনি চিন রওনা হওয়ার আগেই তাঁর সফরকে আগাম ঐতিহাসিক বলে বর্ণনা করেছে বাংলাদেশ সরকার। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টার চিন সফরের মধ্য দিয়ে দু-দেশের সম্পর্ক অন্য উচ্চতায় পৌঁছবে।
২৫ থেকে ২৮ মার্চ চিনের হাইনান প্রদেশে (Hynan province) হবে বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়ার (The Boao Forum for Asia) সম্মেলন। ইউনুস ২৭ তারিখ সেই সম্মেলনে যোগ দেবেন। এ বছরই বাংলাদেশ-চিন কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর। এই উপলক্ষে চিন বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ গঠনের পর চার বছর সদ্য গঠিত দেশটিকে স্বীকৃতি দেয়নি চিনের তৎকালীন নেতৃত্ব। পাকিস্তানের সঙ্গে চিনের সখ্যের কারণেই বেজিং গোড়ায় বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে অনাগ্রহী ছিল।
সেই অতীত পেরিয়ে অনেক আগেই দু-দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পায়। শেখ হাসিনার সময়ে নয়া দিল্লি এবং বেজিং, দু-পক্ষের সঙ্গেই ঢাকার ঘনিষ্ঠতা অনন্য উচ্চতায় ওঠে। যদিও ভারত সরকার নানা সময়ে অনুযোগ করেছে মুক্তিযুদ্ধে অসহযোগিতা করা চিনকে হাসিনা সরকার বাড়তি গুরুত্ব দিচ্ছে।
তাৎপর্যপূর্ণ হল প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে ইউনুসের এই সফরের জন্য চিন বিশেষ বিমান (special flight) পাঠাচ্ছে। যাতে ঢাকা (Dhaka) থেকে তিনি সরাসরি হাইনান গিয়ে সেখান থেকে বেজিং যেতে পারেন। কূটনৈতিক মহল মনে করছে ভারত-বাংলাদেশ শীতল সম্পর্কের সুযোগ নিতে চাইছে চিন। তাই ইউনুসকে বিশেষ খাতির করার আয়োজন।
গত জানুয়ারিতে বেজিং সফরে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন (Touhid Hossain) চারদিনের সফরে যান তিনি। তার আগে ঢাকায় তাঁর সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশে নিযুক্ত চিনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন কথা দেন, তাঁরা বাংলাদেশকে দেওয়া ঋণের উপর সুদের হার কমিয়ে দেবেন। সেই সঙ্গে তিস্তা মহা পরিকল্পনা (Teesta mega project) রূপায়ণে চিন প্রযুক্তিগত এবং পুরো আর্থিক সহায়তা দিতে আগ্রহী বলেও জানান। চারদিনের সফরে তৌহিদ হোসেন চিনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং আইয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন। বেইজিং ছাড়াও বাণিজ্য শহর সাংহাইতে যান তিনি।
বাংলাদেশের চাহিদা মতো ভারত তিস্তার জল না দেওয়ায় অনেক আগেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল চিন। বাংলাদেশ সরকার তিস্তা মহা পরিকল্পনা তৈরি করেছে যাতে বর্ষার জল ধরে রেখে তা দিয়েই বাংলাদেশের উত্তরপ্রান্তের জেলাগুলিতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সেচ ও পানীয় জলের ব্যবস্থা করা যায়। চিন ওই প্রকল্পে অর্থ সাহায্য দিতে প্রস্তুত। হাসিনা সরকার ওই প্রকল্পের ভার ভারতকে দিতে আগ্রহী ছিল। বিএনপি-র যে প্রতিনিধি দলটি গত মাসে বেজিং সফর করে তারা ঘোষণা করে সরকার সুযোগ পেলে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের ভার তারা চিনকে দেবে।
হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক এখনও পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। মনে করা হচ্ছে, এই সুযোগে চিন মহম্মদ ইউনুস সরকারের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলতে তৎপর। তারা জানিয়ে দিয়েছে, তিস্তা মহাপরিকল্পনায় পুরো অর্থ ঢালতে আগ্রহী।