শেষ আপডেট: 15th November 2024 12:56
বাংলাদেশে এখন চরম খাদ্য সংকট চলছে। খোলা বাজারে চাল বাড়ন্ত। বাজারে ষাট টাকার নিচে কোনও চাল নেই। আরও ভয়ানক তথ্য হল, এই প্রথম সে দেশে সাধারণ চালের থেকে আলুর দাম বেশি। গত সপ্তাহে ইউএনডিপি-সহ রাষ্ট্রসংঘের সাহায্যদানকারী সংস্থাগুলি জানিয়েছে, বাংলাদেশের ৪০টি খাদ্য সরবরাহ বিভাগের ৩২টি’তে খাদ্যের জোগান স্বাভাবিক নয়। ১৬ লাখ লোককে সরকার খাবার না জোগালে তারা বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। বহু মানুষের দু’বেলা খাবার জুটছে না। শুক্রবার মহম্মদ ইউনুস সরকারের একশোতম দিনে বাংলাদেশে আলুর দাম চড়ে হয়েছে ৭৫ টাকা কেজি। অতীতে কখনও চালের থেকে আলুর দাম বেশি ছিল না। অন্যদিকে, বাজার থেকে পেঁয়াজ উধাও হওয়ার জোগার।
এই পরিস্থিতিতে অতীতের মতো এবারও সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ভারত। গত সপ্তাহে এপার থেকে এক লপ্তে ৯০ হাজার টন চাল গিয়েছে ওপারে। ভারত থেকে আলু ও পেঁয়াজ ভর্তি শতাধিক ট্রাক বাংলাদেশ সীমান্তে অপেক্ষ করছে। এই সপ্তাহেই সেগুলি বাংলাদেশে যাবতীয় সামগ্রী পৌঁছে দেবে। যদিও এপারেও আলু-পেঁয়াজের দাম ঊর্ধ্বগামী। তারমধ্যেও আগামী রমজান মাসে পর্যাপ্ত খাদ্য সামগ্রী সরবরাহে বাংলাদেশকে কথা দিয়েছে ভারত সরকার।
কিন্তু বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার এবং তাদের দোসরদের কথাবার্তায় ভারতের সহায়তার কোনও ছাপ নেই। বরং ভারত বিরোধিতাই যেন ইউনুস সরকারের একশোতম দিন উদযাপনের প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছে।
বৃহস্পতিবার ঢাকায় বাংলাদেশ সরকারের জনকূটনীতি বিভাগের মহাপরিচালক তৌফিক হাসান রাজধানীর সাংবাদিকদের ডেকে মেগা সাংবাদিক সম্মেলন করে শেখ হাসিনার ইস্যুতে ভারতকে নিশানা করেছেন। বাংলাদেশ সরকারের অভিযোগ, হাসিনা ভারতে বসে রাজনৈতিক বিবৃতি দিচ্ছেন। ভারত সরকারকে এই ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে বলা সত্ত্বেও তারা পদক্ষেপ করেনি।
হাসানের ওই বক্তব্য শোনার পর বাংলাদেশের বহু রাজনৈতিক ও কূটনীতিকও বিস্মিত। কারণ, হাসিনা বিগত এক-দেড় মাস কোনও বিবৃতি দেননি। তাঁর একটি-দুটি ফোনালাপ ফাঁস হলেও সেগুলি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নাকি আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রযু্ক্তি কাজে লাগিয়ে করা হয়েছে তা স্পষ্ট নয়।
বৃহস্পতিবারই বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গির আলম চৌধুরী এক অনুষ্ঠানে অভিযোগ করেন, ভারতীয় মিডিয়ায় বাংলাদেশ নিয়ে লাগাতার অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। একই অভিযোগ করেন পররাষ্ট্র মন্ত্রকের অধিকর্তা তৌফিক হাসানও। অন্যদিকে, আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে বলেন, বাংলাদেশের এখন কোনও মিত্র প্রতিবেশী নেই। লক্ষণীয়, বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্ত আছে শুধু ভারত ও মায়ানমারের। সেনা শাসিত মায়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কোনও কালেই ভাল ছিল না। দু-দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কও সরু সুতোয় ঝুলছে বরাবর। ফলে ভারতকেও তাঁরা এখন বন্ধু প্রতিবেশী মনে করছেন না, স্পষ্ট করে দেন আসিফ। প্রসঙ্গত, অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপকের সরকারে ক্ষমতা ইউনুসের থেকে কিছু কম নয়। বলা হয়, তিনি বর্তমান সরকারে ক্ষমতার দ্বিতীয় ভরকেন্দ্র।
আর এক ক্ষমতাবান উপদেষ্টা ছাত্র নেতা নাহিদ ইসলাম এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে ভারতের উদ্বেগ নিয়ে জোরালো আপত্তি তুলেছেন। তাঁর বক্তব্য, বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিয়ে ভারতের মাথাব্যথা কেন। আমাদের দেশের সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে আমরা যথেষ্ট সচেতন। গত দুর্গাপুজোই তার প্রমাণ। বহু বছর বাংলাদেশে এত নির্বিঘ্নে দুর্গাপুজো হয়নি।
বাংলাদেশে আওয়ামী লিগ বিরোধী শক্তির ভারত বিরোধিতা নতুন নয়। প্রশ্ন হল, ইউনুসের সরকার হঠাৎ করেই দিন তিনেক যাবত সদলবলে সুর চড়িয়েছে কেন। ওয়াকিবহাল মহল মনে করছে অতীতে দলীয় সরকারগুলির মতো নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকারও পুরনো অস্ত্রই ব্যবহার করছে। গণ অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতায় আসা সরকার জন-আকাঙ্খা পূরণের প্রতিশ্রুতি গিয়েছিল। কিন্তু নানা ক্ষেত্রে সরকারের প্রতি গণ-অনাস্থার চিত্রই স্পষ্ট।
তার দুটি কারণ—এক. খাদ্যসামগ্রী-সহ নিত্যপণ্যের আকাশছোঁয়া দাম। বেশিরভাগ সবজির দাম একশো টাকার বেশি। এক ডজন ডিম দেড়শো টাকা। দামের নিরিখে গোটা বাংলাদেশই যেন দুর্গম পর্যটন কেন্দ্র যেখানে সব কিছু দ্বিগুণ-তিনগুণ দামে কিনতে হয়। দুই. আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি। ঢাকার মতো রাজধানী শহর পর্যন্ত রাত আটটা-ন’টার পর চুরি-ছিনতাইয়ের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠছে। একই অবস্থা রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, সিলেটের মতো শহরগুলিতে।
এরই মধ্যে বৃহস্পতিবার ব্রাসেলসভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য বেশ কিছু বিপদের কারণ চিহ্নিত করেছে। যুদ্ধ ও অভ্যন্তরীণ সংঘাত নিয়ে পূর্বাভাস দিয়ে থাকে সংস্থাটি। তারা বলেছে, নাগরিক প্রত্যাশা পূরণই ইউনুস সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। ফলে সরকারের প্রতি গণ-অনাস্থা তৈরি হয়েছে জনমনে। নানা ঘটনায় তার আভাস মিলতে শুরু করেছে।
গত বুধবার ঢাকার একটি হাসপাতালের চিকিৎসাধীন রোগীরা বেড় ছেড়ে দীর্ঘ সময় রাস্তা অবরোধ করে রাখেন। তাদের সঙ্গে দেখা করতে এসে ঘেরাও হয়ে যান স্বাস্থ্য উপদেষ্টা। ওই রোগীরা বেশিরভাগই গণ অভ্যত্থানে আহত। বেশিরভাগের গায়ে গুলির আঘাত রয়েছে। ইউনুস সরকার তিন মাস আগে কথা দিয়েছিল তাদের নিখরচায় চিকিৎসা দেওয়া এবং প্রয়োজনে বিদেশে পাঠানো হবে। সাড়ে তিন মাস হতে চলল অন্তর্বর্তী সরকার কথা রাখেনি।
বৃহস্পতিবার হাসপাতাল থেকে সেই রোগীরা ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় সচিবালয়ে গিয়ে উপদেষ্টাদের সঙ্গে বৈঠক করে এসেছেন। কেউ কেউ হুইল চেয়ারে করে গিয়েছিলেন। বাংলাদেশের জনক্ষোভের এমন নজির নেই। গার্মেন্টস-সহ বিভিন্ন কলকারখানার শ্রমিকদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা পথ অবরোধ লেগেই আছে। লোডশেডিং হয়ে উঠেছে নিত্যকার সঙ্গী।
এমন পরিস্থিতির কারণ হিসাবে বাংলাদেশের একাধিক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ইউনুস সরকারের অগ্রাধিকার হয়ে গিয়েছে ভিন্ন। জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণ, আইন-শৃঙ্খলার উন্নতির তুলনায় সরকার রাষ্ট্র সংস্কারে বেশি জোর দিয়েছে, যা আসলে অন্তর্বর্তী সরকারে কাজই নয় বলে রাষ্ট্র বিজ্ঞান ও জন-প্রশাসন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মহলের অনেকই মনে করছে, দেশে জন-বিক্ষোভের আশঙ্কায় বাংলাদেশের শাসক ও তাদের দোসরেরা ভারত বিরোধিতায় সুর চড়িয়েছে। মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা হচ্ছে, ভারত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। সেই প্রচারে গলা মিলিয়েছে বিএনপি-সহ আওয়ামী লিগ বিরোধী সব শক্তি। বিএনপি-র মহাসচিব মির্জা ফকরুল ইসলাম আলমগীর-সহ দলের নেতারাও ভারতের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে গলা মিলিয়েছেন। বিএনপি সরকারের সমালোচনা করলেও দলটি এখনই অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ বলতে চায় না। অন্যদিকে, জামাত প্রথম থেকেই অন্তর্বর্তী সরকারে একেবারে খুঁটির ভূমিকা পালন করছে। ফলে ভারত বিরোধিতার সুর চড়িয়ে পিঠ বাঁচানোর চেনা রাস্তাই নিয়েছে ইউনুস সরকার।