শেষ আপডেট: 25th August 2024 20:58
দ্য ওয়াল ব্যুরো: বাংলাদেশের মিডিয়া জুড়ে এখন মাইকেল চাকমার কাহিনি। পাঁচ বছর নিখোঁজ থাকার পর বাড়ি ফিরেছেন তিনি। দিনটি গুরুত্বপূর্ণ। ৬ অগাস্ট, অর্থাৎ শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর দিন ভোরে চট্টগ্রামে একটি রাস্তার ধারে চোখ বাঁধা অবস্থায় তাঁকে রেখে যাওয়া হয়। চট্টগ্রামভিত্তিক রাজনৈতিক দল ইউপিডিএফের প্রথমসারির নেতা মাইকেল চাকমা ভেবেছিলেন ওই দিন তাঁকে হত্যা করা হবে। চোখ খোলার পর দেখেন বাড়ির অদূরে দাঁড়িয়ে।
২০১৯ থেকে ২০২৪, এই পাঁচ বছর কোথায় ছিলেন তিনি। ওই নেতার কথায়, দলীয় কাজে ঢাকা গিয়েছিলেন তিনি। রাজধানীর শ্যামলী এলাকা থেকে সাদা পোশাকের কিছু লোক তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। এই পাঁচ বছর তাঁর আয়না ঘরে কেটেছে। হাসিনা দেশ ছাড়ার পর দীর্ঘদিন নিখোঁজ আরও তিন ব্যক্তি বাড়ি ফিরে এসেছেন। তাঁদের একজন বাংলাদেশের নামজাদা আইনজীবী ব্যারিস্টার আহমেদ বিন কাশেম আরমান এবং প্রাক্তন সেনা কর্মকর্তা আব্দুল্লাহিল আমান আজমি।
তাঁরাও বলেছেন, তাঁদের আয়না ঘরে আটক রাখা হয়েছিল। সেই ঘরের বর্ণনা শোনার পর বাংলাদেশের নানা মহলে আলোচনায় ঘুরে ফিরে আসছে সত্যজিৎ রায়ের রূপক ধর্মী সিনেমা ‘হীরক রাজার দেশে’-এর যন্ত্রর মন্ত্রর কক্ষের কথা। রাজার পক্ষে কথা বলার জন্য যে কক্ষে মেশিনের সাহায্যে মগজ ধোলাই করা হত। শেখানো হত, ‘যায় যদি যাক প্রাণ, হীরকের রাজা ভগবান’, ‘ধন্য শ্রমিকের দান, হীরকের রাজা ভগবান’ ইত্যাদি। আয়না ঘর ফেরত ব্যক্তিরা বলছেন, অতীতে যাদের মুক্তি দেওয়া হয়, তাদের কাছ থেকে লিখিয়ে নেওয়া হয়েছিল, তারা বাইরে গিয়ে সরকার, বিশেষ করে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কথা বলবে না। বলবে না আটক জীবনের কথাও। নিরুদ্দেশ থাকাকালে কোথায়, কীভাবে ছিলেন তাও গোয়েন্দারা শিখিয়ে দিত।
সব দেশের পুলিশ-সহ নিরাপত্তা বাহিনীগুলির টর্চার বা শারীরিক ও মানসিক পীড়ন সেল আছে। পশ্চিমবঙ্গে একটা সময় সিআইডির রিট্রিটের কথা মুখে মুখে ঘুরত। টালিগঞ্জে সিআইডির ওই বাড়িটি ছিল আসলে লকআপ। সিআইডির হাতে ধৃতদের সেখানে নিয়ে রাখা হত। নানা সময়ে অভিযোগ শোনা গিয়েছে সেখানে ধৃতদের অকথ্য শারীরিক ও মানসিক পীড়ন করা হত। কলকাতা পুলিশের লালবাজার লকআপ সম্পর্কেও একই অভিযোগ ছিল একটা সময়। মানবাধিকার কমিশন সক্রিয় হওয়ার পর টর্চারের অভিযোগ অনেকটাই কমে এসেছে।
কিন্তু হাসিনার জমানায় বাংলাদেশের আয়না ঘর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার রিপোর্টেও স্থান পেয়েছে। এমনকী রাষ্ট্রসংঘও আয়না ঘর নিয়ে সরকারকে সতর্ক করে।
শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর তাঁর জমানার নানা অপকীর্তি একের পর এক সামনে আসতে শুরু করেছে। তাতে ব্যাঙ্ক জালিয়াতি, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অর্থ নয়ছয়, সরকারি প্রকল্পে কোটি কোটি টাকা কাটমানি খাওয়ার অভিযোগ আছে। তবে সব কিছু ছাপিয়ে চর্চা চলছে ‘আয়না ঘর’ নিয়ে। বাংলাদেশের বহু আলোচিত এই বিশেষ কক্ষ নিয়ে কৌতূহল, উদ্বেদ, উৎকণ্ঠা নতুন নয়। লোকে শুধু জানত, গুম হওয়া ব্যক্তিদের আয়না ঘরে নিয়ে আটকে রাখা হয়। তবে আয়না ঘর কোথায় অবস্থিত, কেমন সেই ঘরের চেহারা সে ব্যাপারে কারও কোনও ধারণা ছিল না। সেই কক্ষের ছবিও হাসিনা দেশ ছাড়ার আগে কোনও মিডিয়ায় ছাপা হয়নি। এমনকী এখনও স্পষ্ট নয়, আয়না ঘর নামে গোপন কুঠুরি আসলে সরকারের কোন এজেন্সির অধীনে।
তবে সে দেশের অধিকাংশ মিডিয়ার মতে, এটি বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইয়ের গোপন কুঠুরি। যেখানে সরকার বিরোধীদের আটকে রেখে মারধর সহযোগে মগজ ধোলাই করা হত। দিনের পর দিন আটকে রেখে কথা আদায় করার চেষ্টা হত। সঙ্গে চলত অসহনীয় অত্যাচার। আবার মাইকেল চাকমার মতো শারীরিক নিপীড়ন ছাড়া স্রেফ আটকে রাখা হয়েছে বহু মানুষকে। কারণ, চাকমা এলাকায় থাকলে তাঁর দল পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বাধীকারের দাবিতে আন্দোলন জোরদার করতে পারত। তাতে সরকারের বিপাকে পড়ার আশঙ্কা ছিল।
বাংলাদেশের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের দাবি, শেখ হাসিনার ২০০৯ পরবর্তী শাসনকালে প্রায় ছয়শো মানুষ গুম হয়েছেন। সরকারের বিভিন্ন নিরাপত্তা এজেন্সির লোকেরা সাদা পোশাকে বাড়ি, অফিস, রাস্তা, ট্রেন, বাস থেকে এই সব লোককে অপহরণ করে বলে অভিযোগ। বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের ব্যাপারে পরে সরকারের সব এজেন্সিই দায় অস্বীকার করে। গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিজনদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’ সম্প্রতি ঢাকায় এক সমাবেশ করে। তারা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে, গুম হওয়া পরিজনদের ফেরানোর ব্যবস্থা করুক। অন্তর্বর্তী সরকার এই ব্যাপারে একটি কমিশন গঠনের কথা জানিয়েছে যারা গুম হওয়া ব্যক্তিদের বিষয়ে প্রথমে নিরাপত্তা এজেন্সিগুলির মতামত শুনবে। যদিও আয়না ঘরের অস্তিত্ব নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারও নীরব। মনে করা হচ্ছে, নিরাপত্তা এজেন্সিগুলির চাপেই এই ব্যাপারে সরকারি কর্তারা মুখ খুলছেন না। এমনকী আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা তথা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম উপদেষ্টা নাদিম ইসলাম, যাঁরা ক’দিন আগেও আয়না ঘর নিয়ে হাসিনা সরকারের মুণ্ডপাত করেছেন তাঁরাও এখন এই বিষয়ে নীরব।
হাসিনার সময়ে অভিযোগ করা হত, গুম হওয়া ব্যক্তিদের আয়না ঘরে নিয়ে রাখা হত। সেই ঘর এমনই কখনও সামান্য সূর্যের আলো ঢুকলে শুধু নিজের ছায়া টুকু দেখার সুযোগ মিলত। মনে করা হয়, সেই কারণেই এই গুম ঘরের নাম রাখা হয় আয়না ঘর।
চট্টগ্রামের বাসিন্দা মাইকেল চাকমা যেমন জানিয়েছেন, তাঁকে মারধর করা হয়নি। তবে যে অবস্থার মধ্যে দিন কাটাতে হয়েছে তা যে কোনও মানুষের কাছে অসহনীয়। তাঁর কথায়, ‘পাঁচ বছরে আমাকে একাধিক জায়গায় নিয়ে রাখা হয়েছে। যা থেকে বোঝা যায় আয়না ঘর দেশের নানা শহরে আছে।’ তিনি বলেছেন, ‘যে ঘরে রাখা হত তাতে কবর বললেও কম বলা হয়। নড়াচড়া করার জায়গা নেই। বলতে গেলে গর্তের মধ্যে দিন কাটত।’