শেষ আপডেট: 6th March 2025 23:13
আজ ৭ মার্চ। বাঙালির ইতিহাসে দিনটির গুরুত্ব স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ১৯৭১-এর এই দিনে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (Sheikh Mujibur Rahaman) যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন, সেটি ছিল বাংলাদেশ (Bangladesh) নামে দেশটির আবির্ভাব ঘোষণা। ভাষণটি ছিল বাঙালির মুক্তির সনদ (charter of liberty)।
সেই ভাষণে বাঙালি জাতিকে তিনি জাতীয় মুক্তির মোহনায় দাঁড় করিয়েছিলেন। জাতিসংঘের সংস্থাইউনেস্কো শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক সেই ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যের (ওয়ার্ল্ড ডকুমেন্টারি হেরিটেজ) অংশ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছে। পৃথিবীতে অন্য কোনও ভাষণ এতবার উচ্চারিত হয়নি। আমরা যদি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের বক্তৃতা বিশ্লেষণ করি তবে দেখব, অলিখিত একটি বক্তৃতা, ভাষণের সময় ১৯ মিনিট, শব্দ সংখ্যা ১৩০৮টি। আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গের ভাষণ (Gettysburg Address)-এর শব্দ সংখ্যা ২৭২, সময় ৩ মিনিটের কম এবং লিখিত। অপরদিকে, মার্টিন লুথার কিং-এর ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’ (I have a dream) ভাষণটির সময় ১৭ মিনিট, শব্দ সংখ্যা ১৬৬৭। কিন্তু বিশ্বের কোনও নেতার ভাষণ এমন সংগ্রামমুখর ১০ লক্ষাধিক মুক্তিকামী নিরস্ত্র মানুষের সামনে ধ্বনিত হয়নি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ৭ মার্চ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষণটি প্রদান করে মানুষকে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে, নিরস্ত্র বাঙালিকে সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তরিত করে মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন।
বাঙালির এই দিনটি হঠাৎ করে আসেনি। ১৯৪৭ সালে ধর্মীয় চিন্তা, সাম্প্রদায়িকতার মানসিকতা ও দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে গঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ২৪ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিসত্তা, জাতীয়তাবোধ ও জাতিরাষ্ট্র গঠনের যে ভীত রচিত হয় তারই চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর ছাত্র-কৃষক-শ্রমিকসহ সর্বস্তরের বাঙালি স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। এই দিনটির জন্যই বঙ্গবন্ধু জীবনভর সংগ্রাম করেছেন।
দীর্ঘ ১৩টি বছর বঙ্গবন্ধু কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি উপলব্ধি করেছেন, ‘এই পাকিস্তান বাঙালিদের জন্য হয়নি, বাংলার ভাগ্যনিয়ন্তা বাঙালিদের হতে হবে।’ সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্যই এত আন্দোলন, এত সংগ্রাম, যার একটি চূড়ান্ত পর্যায় ১৯৭১-এর ৭ মার্চ।
১৯৪৮ সালে বাংলা ভাষা আন্দোলনের সূচনার মাধ্যমে বাঙালির অধিকার আদায়ের পটভূমি সৃষ্টি হয়। ৫২-এর বাংলা ভাষা আন্দোলনের শাহাদত বরণকারী রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত এর রক্তে স্বাধীনতার বীজ রচিত হয়। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির মুক্তিবার্তা ৬-দফা ঘোষণা করেন, সেই ৬-দফা দাবির সমর্থনে সারাদেশে জনসমর্থন সৃষ্টি করেন। আমাদের ইতিহাসবিদ ও বিজ্ঞজনেরা বঙ্গবন্ধুর ৬-দফাকে বাঙালির মুক্তির সনদ মর্মে আখ্যায়িত করেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি ৬-দফাকে বাঙালির ‘মুক্তিবার্তা’ ও ৭ই মার্চের ভাষণকে ‘মুক্তির সনদ’ বলি। এটাকে কেউ দয়াকরে ইতিহাস বিকৃতি মনে করবেন না। এটি আমার ভাষায় আমার আবেগে ঐতিহাসিক ঘটনার উপস্থাপন মাত্র।
১৯৬৬ সালে বাঙালির জন্য বঙ্গবন্ধুর মুক্তিবার্তা ৬-দফা এবং ছাত্র সমাজের ১১-দফার ভিত্তিতে বাঙালির আন্দোলন ধাপে ধাপে চূড়ান্ত লক্ষ্যে এগিয়ে যায়, ১৯৬৯ এর গণআন্দোলন হয় এবং গণঅভ্যুত্থানে সামরিক জান্তা আয়ুবের পতন হয়। স্বাধীনতার চেতনার উপর দাঁড়িয়েই ১৯৭০ সালে আওয়ামী লিগ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।
কিন্তু পাকিস্তানিরা বাঙালির তথা আওয়ামী লিগের বিজয়কে মানতে পারেনি। ক্ষমতায় বসতে দেয়নি। স্বাভাবিক নিয়মের ব্যতয় ঘটিয়ে নিরস্ত্র বাঙালির উপর গুলি চালায়। ফলশ্রুতিতে ৭ মার্চ আসে। রচিত হয় বাঙালির স্বাধীনতার দলিল, মুক্তির সনদ এবং তার মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। সেদিন বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা যুদ্ধের সকল প্রকার দিকনির্দেশনা দিয়ে মুক্তিকামী জনতার উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, আওয়ামী লিগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দিবো, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ্। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।
বাংলা ও বাঙালি মায়ের আরাধনার স্বপ্নপুরুষ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেওয়া শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির হৃদয়ে জায়গা করে নিয়ে ১৯৬৯ সালে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত হন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালির ‘অবিসংবাদিত নেতা’ মর্মে বিশ্বের মানচিত্রে জায়গা করে নেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুকে ‘জোলিও কুরি’ শান্তি পদকে ভূষিত করে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। ১৯৭২ সালের ১০ অক্টোবর বিশ্বশান্তি পরিষদের প্রেসিডেনশিয়াল কমিটির সভায় ১৪০টি দেশের সদস্যদের উপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়কত্বের প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি’ পদক প্রদান করার বিষয়ে উপস্থিত সবাই একমত পোষণ করেন। পরের বছর ২৩ মে এশিয় শান্তি সম্মেলনের এক আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকে সেই পদক তুলে দেওয়া হয়। সেই অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলার নন, তিনি বিশ্বের এবং তিনি বিশ্ববন্ধু।’
লেখক আইনজীবী, মতামত ব্যক্তিগত