শেখ মুজিবুর রহমান
শেষ আপডেট: 17th March 2025 15:37
আজ, সোমবার, ১৭ মার্চ, বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের (Bangladesh) মহান স্থপতি, সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের (Sheikh Mujibur Rahman) ১০৬তম জন্মদিন। এই দিনটি শুধু তাঁর জন্মের স্মৃতি নয়, বাংলাদেশের জাতীয় শিশু দিবস হিসেবেও পালিত হয়। এটি তাঁর শিশুকালের স্মৃতি ও জনগণের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার প্রতীক। শুভ জন্মদিন ইতিহাসের এই মহানায়ককে, যিনি শতাব্দীর পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে বাঙালি জাতির মুক্তির প্রভাকর হয়ে আলো ছড়িয়েছেন। তাঁর জীবন ও আদর্শ বাঙালির প্রতিটি প্রজন্মের জন্য চিরন্তন প্রেরণার উৎস।
টুঙ্গিপাড়ার গ্রামীণ সমাজে তাঁর শৈশব কেটেছে। আঁকাবাঁকা নদী, হাওড়-বাঁওড়, শস্যশ্যামল প্রকৃতি আর গ্রামের মানুষের সঙ্গে গভীর সংযোগ তাঁকে জনগণের প্রতি গভীর টানে আবদ্ধ করেছিল। শিশুকাল থেকেই তিনি গ্রামের মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আবেগ-অনুভূতি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন।
তিনি দেখেছেন জমিদার (Jaminder) তালুকদার ও মহাজনদের শোষণ-অত্যাচার, প্রজাপীড়ন। এসব দেখে তিনি চরমভাবে ব্যথিত হতেন। একই সঙ্গে গ্রামের হিন্দু-মুসলমানের Hindu-Muslim) সম্মিলিত সম্প্রীতির সামাজিক আবহে তিনি দীক্ষা পান অসাম্প্রদায়িক চেতনায়। এই শৈশবের অভিজ্ঞতাই তাঁকে পরবর্তী জীবনে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রামে অবিচল করে তুলেছিল।
কিশোর বয়সেই শেখ মুজিব রাজনীতিতে পা রাখেন। গোপালগঞ্জ (Gopalganj) মিশন স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় তৎকালীন ব্রিটিশবিরোধী ( against British imperialism) আন্দোলনে যোগ দিয়ে তিনি প্রথমবার গ্রেপ্তার হন। এই ঘটনা তাঁর জীবনে টার্নিং পয়েন্ট। এখান থেকেই শুরু হয় তাঁর আজীবন সংগ্রামী জীবনের অভিযাত্রা। তিনি সারাজীবন এদেশের মাটি ও মানুষের অধিকার ও কল্যাণের জন্য লড়েছেন। ১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় (communal riot) শান্তি স্থাপনে তাঁর সাহসী ভূমিকা বাঙালির মনে তাঁকে আস্থার প্রতীকে পরিণত করে। পরে ইসলামিয়া কলেজে (Islamia College) ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো নেতার সান্নিধ্যে আসেন। বাংলার ইতিহাসে তখন উত্তাল সময় চলছিল, আর এই সময়েই তাঁর নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে।
বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য শেখ মুজিবের জীবন ছিল এক অবিরাম সংগ্রামের গল্প। তিনি ১৪ বছর পাকিস্তানি কারাগারে অন্ধপ্রকোষ্ঠে বন্দি থেকেছেন, দু’বার ফাঁসির মঞ্চে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু আত্মমর্যাদা ও জাতির অধিকারের প্রশ্নে কখনও মাথা নত করেননি। দীর্ঘ ২৩ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের পথপরিক্রমায় তিনি ১৯৪৮ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলিগ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪-র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬-র ছয় দফা, ১৯৬৯-র গণঅভ্যুত্থান—এসব মাইলফলক পেরিয়ে ১৯৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে তিনি বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ—'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম'—বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার চূড়ান্ত সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ করে। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তারের আগে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে ঐতিহাসিক ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধে বাঙালি জাতি স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনে। ৩০ লাখ শহীদের প্রাণ ও ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বিশ্ব মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন মধ্য দিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠন ও পুনর্বাসনে আত্মনিয়োগ করেন তিনি। তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ছিল স্বাধীন বাংলাদেশে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। এর জন্য তিনি জেল-জুলুম, হুলিয়া—কোনও কিছুই পরোয়া করেননি। শত যন্ত্রণা ও কষ্ট তিনি হাসিমুখে সহ্য করেছেন।
কিন্তু স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট, পরাজিত শক্তি ও মানবতার শত্রু ঘাতকের দল তাঁকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে। এই ঘটনা বাঙালি জাতির জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। তবু তাঁর আদর্শ মুছে ফেলা যায়নি। শকুনের দল শত চেষ্টা করেও ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুছতে পারেনি, পারবেও না। তাঁর আদর্শের বার্তা চিরন্তন হয়ে নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের মুক্তির স্রোত হয়ে প্রবাহিত হবে। ব্যক্তি মুজিবকে হত্যা করা গেলেও আদর্শের মুজিবকে হত্যা করা সম্ভব না, তাঁর চেতনা ও আদর্শ বাঙালির হৃদয়ে চিরঞ্জীব। সমগ্র বিশ্ব তাঁকে যথাযোগ্য মর্যাদায় স্মরণ করে।
বাংলা, বাঙালি, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এক অভিন্ন। শেখ মুজিব মানেই বাংলাদেশ। তিনি চিরন্তন, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে অবিনাশী চেতনার প্রতীক। তাঁর স্বপ্নের উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়তে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আলোকিত বাংলাদেশ আজ গভীর ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের শিকার।
বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে আরও উঁচুতে তুলতে নতুন প্রজন্মকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে দীক্ষিত হতে হবে। তাঁর জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রামে অবিচল থাকতে হবে। তিনি শুধু বাঙালির নন, সারা বিশ্বের শোষিত-নির্যাতিত মানুষের মুক্তির পথপ্রদর্শক। তাঁর জীবন ছিল এক মহাকাব্য—স্বাধীনতার মহাকাব্য।
বাংলা, বাঙালি, বঙ্গবন্ধু একটা মহাকাব্য। চাইলেই তাঁকে ছিঁড়ে ফেলা যায় না। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর (32 Dhanmondi) বাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে ফেললেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নিচিহ্ন হয়ে যাবে একথা ভাবা আর বোকার স্বর্গে বাস করা একই কথা। মহাকাব্যের স্রষ্টা যিনি, তাঁকে বাদ দিয়ে কেমন করে মহাকাব্য চর্চা হয়? মহাকাব্যের স্পন্দন রচিত হয়েছে যাকে ঘিরে তাঁকে ছাড়া মহাকাব্য অচল।
বদহজমের ইতিহাস চর্চা হয়েছে দীর্ঘ সময় যা চলমান। ইতিহাস বিকৃতিকারীরা কখনই সেই সত্যি ইতিহাস জাতির সামনে আসতে দেয়নি। কিন্তু তারা জানে না ইতিহাস কখনও মুছে ফেলা যায় না, ইতিহাস নিজেই নিজের শক্তিতে ভেসে উঠবে। অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ প্রকাশের পর ভাষা আন্দোলনের বিশুদ্ধ ইতিহাস জাতির সামনে ফুটে ওঠে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কেবল একজন নেতা নন, তিনি বাঙালি জাতির আত্মা। তাঁর জন্মদিনে আমরা শুধু তাঁকে স্মরণ করি না, তাঁর আদর্শকে পুনরুজ্জীবিত করি। তাঁর জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আমাদের শেখায়—মানুষের জন্য বাঁচতে, অধিকারের জন্য লড়তে, মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে এবং মানুষকে ভালবাসতে। আজকের এই দিনে আমরা শপথ নিই, আমরা মানুষকে ভালবাসবো এবং ভালবাসা দিয়েই মানুষের মন জয় করবো তাহলেই তাঁর প্রতি আমাদের সত্যিকারের শ্রদ্ধা জানানো হবে।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু!
লেখক:
সাংগঠনিক সম্পাদক
বাংলাদেশ আওয়ামী লিগ