শেখ হাসিনা
শেষ আপডেট: 4 December 2024 10:09
বিজয়ের মাসের (বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ১৯৭১-এর ডিসেম্বর পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণ) সূচনা দিনে অর্থাৎ ১ ডিসেম্বর এবারও ভাষণ দিয়েছেন শেখ হাসিনা। ভারতে অবস্থানরত আওয়ামী লিগ নেত্রী ওই দিন দিল্লি থেকে ভার্চুয়াল মাধ্যমে আমেরিকা প্রবাসী বাংলাদেশিদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছেন।
হাসিনার সেই ভাষণের অডিও সংবাদমাধ্যম পেয়েছে মঙ্গলবার বিকালে। মাঝে দু'দিন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য মিডিয়ার অজানা থাকল কীভাবে?
আওয়ামী লিগের অন্দরে সেই প্রশ্ন ঘোরাফেরা করেছে। দলীয় সূত্রের খবর, হাসিনার বক্তব্য মিডিয়াকে জানানোর কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা এখনও গড়ে তুলতে পারেনি তার দল। যদিও বুধবার চার মাস হয়ে গেল ৭৫ বছর বয়সি দলটি ক্ষমতার বাইরে এবং শেখ হাসিনা সহ দলের প্রথমসারির নেতা-নেত্রীরা কেউ দেশে নেই। যদিও বিদেশি মিডিয়ার সঙ্গেও দলের প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্ক নেই। কতিপয় অতি উৎসাহী, পার্টি দরদী নেতা ব্যক্তিগত উদ্যোগে মিডিয়াকে হাসিনা ও দলের বক্তব্য জানাচ্ছেন। কিন্তু দলের তরফে সরকারিভাবে দায়িত্ব না দেওয়ায় তাদেরও সীমাবদ্ধতা আছে।
শুধু হাসিনার ভাষণই নয়, সরকারিভাবে দলের কথা জানাতেও কাউকে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়নি। দল মাঝেমধ্যে ফেসবুকে গর্জন করছে।
যদিও দলীয় সুত্রের খবর, দেশে দলের কাজকর্ম চালানোর জন্য স্বচ্ছ ভাবমূর্তির কাউকে দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু সেই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হয়নি। বিদেশি সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার জন্য কাউকে দায়িত্ব দেওয়ার কথা আলোচনা হয় নেতাদের টেলিফোনিক আলোচনায়। কিন্তু নেতারা 'হ্যাঁ' বা 'না' কোনও মন্তব্য করেননি। সিদ্ধান্তও জানাননি।
গণ অভ্যুত্থানের পর হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় কিছুদিন মিডিয়ায় সক্রিয় ছিলেন। তিনিও প্রায় সাড়ে তিনমাস যাবত নীরব। আত্মগোপনে থাকা একাধিক নেতার বক্তব্য, সজীব বেশ কিছুদিন হল তাঁদের ফোন ধরছেন না। জবাব দিচ্ছেন না মেসেজের। একই অভিজ্ঞতা হয়েছে বাংলাদেশের বহু প্রথমসারির সাংবাদিকদের।
আওয়ামী লিগের কেন এমন দশা। কেন নেতারা রা কাড়ছেন না? দলীয় সূত্রের খবর, দলকে বিপদে ফেলে দেশ ছাড়লেও কোনও নেতাই দলীয় পদ ছাড়তে রাজি নন। তাঁদের আশঙ্কা, বিপদের সময় বিকল্প নেতৃত্ব দলের হাল ধরলে অবস্থার পরিবর্তনের পর তাঁরা আর কল্কে পাবেন না। তাই সাংগঠনিক পদ তো দূরের কথা, সাংবাদিকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেও কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে না। পদে থাকা নেতা ও তাদের পরিবারের লোকেরা সেটা চাইছে না। এমনীতেই আওয়ামী লিগ গোষ্ঠী ও পরিবারতন্ত্রের শিকার। যেমন, খুলনা, যশোরের মতো এলকায় শেখ পরিবার অর্থাৎ হাসিনার আত্মীয়সস্বজনেরাই আওয়ামী লিগের শেষ কথা। দল ও প্রশাসন মিলিয়ে শেখ পরিবারের জনা পনেরো সদস্য গুরুত্বপূর্ণ পদ আঁকড়ে ছিলেন। তাঁরা সকলেই দেশ ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে রয়েছেন। দলের পদ ছাড়েননি একজনও। এমনকী সেনা, পুলিশ, বিএনপি-জামাতের সঙ্গে বোঝাপড়া করে ঘরবাড়ি, সম্পত্তি বাঁচিয়ে নিয়েছেন।
আওয়ামী লিগের এক নেতার কথায়, গণ অভ্যুত্থানের মাস খানেকের মাথায় ফোনে ফোনে নেতাদের কথা হয়েছিল, হাসিনাকে মাথায় রেখে দেশে দল পরিচালনার জন্য একটি অ্যাডহক কমিটি গড়া হোক। এমনকী বিদেশে বসবাসকারী লিগ নেতাদের নিয়ে কমিটি করার কথাও ভাবা হয়েছিল। কিন্তু প্রস্তাব নিয়ে রা কাড়েননি ক্ষমতাসীন নেতারা। এক নেতা বলেন, পরিস্থিতি এমন যে কাল প্রশাসন কোনও বৈঠকে ডাকলে দলের কে প্রতিনিধিত্ব করবেন তা কেউ জানে না। যদিও সরকারিভাবে দল নিষিদ্ধ নয়। জামাত-বিএনপির অত্যাচার, সেনা-পুলিশের মামলা-হামলা সত্বেও নানা ঘটনায় দেখা গিয়েছে এখনও দলের নীচুতলার কর্মী সমর্থকেরা সাহস করে প্রতিবাদে শামিল হচ্ছেন। কিন্তু তাদের নেতৃত্ব দেওয়া, বিপদে পাশে থাকার কেউ নেই। যেমন সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা গিয়েছে, উন্মত্ত, মারমুখী জনতার হাতে ঘেরাও হয়ে যাওয়া এক আওয়ামী লিগ কর্মী বলছেন, আপনারা আমারে মারেন, ধরেন, খুন করেন, আমি বলব, জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। জনতা তাঁকে বেধড়ক মারধোর করে। বস্তুত, এই ধরনের কর্মী সমর্থকেরা আছে বলেই আওয়ামী লিগকে নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ও বিএনপি সহ তাদের সহযোগীদের অনেক সময় রজ্জুতে সর্পভ্রম হচ্ছে এবং দিনরাত আওয়ামী আতঙ্কে ভুগছেন। কিন্তু হাসিনার দলের হেলদোল নেই।
ঢাকায় স্বাভাবিক জীবনযাপন করা এক নেতার কথায়, নেতারা এতদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকায় কর্মী সমর্থকেরা মনোবল হারিয়ে বিএনপি, জামাতের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন। তাদের বেশিরভাগই রুটিরুজি, কেউ চাকরি, কেউ ব্যবসা বাঁচাতে এই কৌশল নিতে বাধ্য হচ্ছেন।
সম্প্রতি হাসিনা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সপ্তাহে অন্তত একটি করে ভার্চুয়াল সভা করবেন। দ্য ওয়াল-এ সপ্তাহ দুই আগে তাঁর এই পরিকল্পনার কথা লেখা হয়েছিল। দেখা যাচ্ছে তিনি চার পাঁচটি সভা করলেও সেগুলির বিষয়ে ভার্চুয়াল সভায় হাজির নেতারা বাদে বাকিরা অন্ধকারে।
দলের এক নেতার কথায়, হাসিনার ভাষণের সমান্তরালে দেশে দলকে মাঠে নামানো নাম গেলে আওয়ামী লিগের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে যাবে।