শেখ হাসিনা।
শেষ আপডেট: 24 January 2025 03:06
আগামী মাসে ইউনুস সরকারের বিরুদ্ধে সদলবলে পথে নামার পরিকল্পনা করেছে আওয়াম লিগ (Awami League)। শহরে ওয়ার্ড এবং গ্রামাঞ্চলে উপজেলা স্তর পর্যন্ত পার্টি ও দলের ছাত্র, শিক্ষক, শ্রমিক, কৃষক-সহ সব অঙ্গ সংগঠনকে এই পরিকল্পনার কথা জানিয়ে প্রস্তুত থাকতে বলেছে আওয়ামী লিগের শীর্ষ নেতৃত্ব। বলা হয়েছে, আপা অর্থাৎ দলনেত্রী শেখ হাসিনা ১ ফেব্রুয়ারির পর যে কোনও দিন পথে নামার নির্দেশ দিতে পারেন। তাঁর নির্দেশ আসা মাত্র পথে নামতে হবে।
চলতি সপ্তাহের শুরুতে দেশে ও দেশের বাইরে থাকা আওয়ামী লিগের জাতীয় স্তরের নেতারা তিনদিন ধরে কয়েক দফা বৈঠক করেছেন। হাসিনা ওই বৈঠকগুলিতে হাজির ছিলেন না। আওয়ামী লিগের সাধারণ সম্পাদক ওয়াবদুল কাদের অসুস্থ। গত নভেম্বর পর্যন্ত তিনি দেশেই আত্মগোপন করেছিলেন। চিকিৎসার প্রয়োজনে নভেম্বরের শেষ দিকে দেশ ছাড়েন বলে খবর। হাসিনা তাঁকে আপাতত বিশ্রামে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। ফলে তিন দিনের ম্যারাথন বৈঠকে তিনিও ছিলেন না।
এখন দলের সাংগঠনিক বিষয়ে নেত্রীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন যুগ্ম সম্পাদকেরা। তিনদিনের পর্যালোচনা বৈঠকে দেশের পরিস্থিতির চুলচেরা বিশ্লেষণ করেন নেতারা। নানা সুত্র থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করা হয় বৈঠকে। ৫ অগাস্টের পর বিগত সাড়ে পাঁচ মাসে পরিস্থিতির গুণগত পরিবর্তন হয়েছে বলে অধিকাংশ নেতা সহমত হন। তাঁদের মতামতের ভিত্তিতে হাসিনা ফেব্রুয়ারিতে পথে নামার প্রস্তুতি জানুয়ারিতেই সেরে ফেলার নির্দেশ দেন নেতাদের। আওয়ামী লিগ সভাপতির সেই নির্দেশ পৌঁছে গিয়েছে ওয়ার্ড ও উপজেলা কমিটির কাছে।
হাসিনাকে জানানো হয়, জিনিসপত্রের দাম এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে দেশবাসী তিতিবিরক্ত। মাত্রা ছাড়িয়েছে বিএনপির চাঁদাবাজি এবং বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব এবং জামায়াতে ইসলামির দাদাগিরি। মানুষ প্রকাশ্যেই বলছেন, ‘আগেই ভাল ছিলাম’। এক যুগ্ম সম্পাদকের কথায়, ‘সামাজিক মাধ্যমে আওয়ামী লিগের বিরুদ্ধে ক্ষোভ-অসন্তোষের তেজ কমে এসেছে। মানুষ প্রকৃত পরিস্থিতি বুঝতে পারছেন।’ কেউ সমাজমাধ্যমে লিখেছেন, ‘অভ্যুত্থানের বিনিময়ে কী পেলাম?’ কমেন্ট বক্সে মানুষ রসিকতা করে মন্তব্য করছে, ‘কেন! চালের দাম ৯০-৯৫, আলুর কেজি ৮০, এত দাম কী ছিল?’
জনক্ষোভের এই সব নমুনাকে ভাষণে হাতিয়ার করছেন হাসিনা। গত রবিবার তিনি তিনটি ভার্চুয়াল সভায় ভাষণ দিয়েছেন। প্রতিটি ভাষণেই বলেন, ‘বাজারে জিনিসপত্রের দাম শুনে মানুষ পকেটের বদলে মাথায় হাত দিচ্ছে।’ আরও বলেন, ‘দেশে বহু মানুষের দু’বেলা খাওয়া জুটছে না। মানুষের ডাস্টবিনের খাবার ভাগ বসাতে কুকুরের সঙ্গে লড়াই করছে।’
ফেব্রুয়ারি মাসে পথে নামার সিদ্ধান্তের পিছনে একটি কৌশলগত কারণও আছে। হাসিনা বিরোধী আন্দোলনে রাষ্ট্রীয় দমন পীড়নের অভিযোগ নিয়ে রাষ্ট্রসংঘের তদন্তকারী দলের আগামী মাসে রিপোর্ট প্রকাশ করার কথা। সেই সময় তদন্তকারী দলের সদস্যরা ঢাকায় আসবেন বলে ঠিক আছে। প্রধান উপদেষ্টা মহম্মদ ইউনুস বর্তমানে সুইজারল্যান্ড সফর করছেন। সেখানে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বার্ষিক সভার ফাঁকে ইউনুস বৈঠক করেন রাষ্ট্রসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্কের সঙ্গে। তুর্ক জানিয়েছেন, গত বছর জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত নৃশংসতা সম্পর্কে রাষ্ট্রসংঘের অনুসন্ধান প্রতিবেদন তৈরির কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে তা প্রকাশ করা হবে।
আওয়ামী লিগ সেই কারণে ৫ অগাস্ট পরবর্তী নৃশংসতার চিত্র তুলে ধরতে পথে নামার প্রস্তুতি নিয়েছে। ওই সময় অন্তর্বর্তী সরকার চাপে থাকবে এবং আন্দোলন দমনে কঠোর পদক্ষেপ করবে না বলে নেতারা মনে করছেন। পার্টির একটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় রাষ্ট্রসংঘের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে দেখা করে অন্তর্বর্তী সরকারের সাড়ে পাঁচ মাসে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের খতিয়ান তুলে ধরবেন।
ইতিমধ্যে ৫ অগাস্ট থেকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রতিটি নৃশংসতার ঘটনার দিন-তারিখ ধরে ‘দ্য অগাস্ট ফাইলস: আনটোল্ড স্টোরিজ’ নামে দীর্ঘ রিপোর্ট তৈরি করিয়েছে দল। রাষ্ট্রসংঘের প্রতিনিধি দলকে কিছু এলাকায় সশরীরে যাওয়ার অনুরোধও করা হবে। ঠিক হয়েছে, তাঁরা সম্মত হলে ঢাকার ধানমুণ্ডিতে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িটি যা ছিল জাতীয় স্মৃতি ভবন এবং আওয়ামী লিগ সভাপতি শেখ হাসিনার দলীয় দফতরে নিয়ে যাওয়া হবে ধ্বংসের নির্দশন তুলে ধরতে। ওই সময় দেশে থাকা কোনও নেতাকে সরকারিভাবে দলের মুখপাত্র ঘোষণা করতে পারেন হাসিনা। এখন সরকারিভাবে কেউ মুখপাত্রের দায়িত্বে নেই। যুগ্ম সম্পাদক এবং সাংগঠনিক সম্পাদকেরা নেত্রীকে জানিয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া দেন।
কীভাবে পথে নামবে আওয়ামী? পার্টি সুত্রে জানা গিয়েছে, পার্টি ও দলের অঙ্গ সংগঠনগুলির সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন শ্রেণি, পেশার মানুষকে পথে নামানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। জানুয়ারি মাস জুড়ে তাদের সঙ্গে জনসংযোগ সেরে ফেলার নির্দেশ দিয়েছে দল। এই প্রচারের থিম ‘কেমন ছিলেন, কেমন আছেন।’ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছেন, ৪ অগাস্ট পর্যন্ত চাল-ডাল-তেন-নুনের কী দাম ছিল, এখন কত হয়েছে তার খতিয়ান মানুষের সামনে তুলে ধরতে। একইভাবে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও তুলনা টেনে প্রচারের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। বিগত সাড়ে পাঁচ মাসে ইউনুস সরকার কীভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে সে বিষয়েও প্রচারে জোর দিতে বলেছেন হাসিনা।
এক সঙ্গে গোটা দেশে ঢাকা সহ ৬৪ জেলার সদর থেকে উপজেলা পর্যন্ত মিটিং-মিছিল করার পরিকল্পনা করেছে দল। তাতে দলের প্রতাকা থাকবে কি না সে ব্যাপারে স্থানীয় নেতৃত্বকে সিদ্ধান্ত নিতে বলা হয়েছে। গত শনিবার ব্যবসা বনধ করে আওয়ামী লিগ। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উপর কর বৃদ্ধির প্রতিবাদে হওয়া বনধের দিন বহু জায়গায় দল বিনা বাধায় পার্টির পতাকা নিয়ে মিটিং-মিছিল করেছে। আগের মতো প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়নি।