শেষ আপডেট: 29th August 2024 12:01
দ্য ওয়াল ব্যুরো: বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জমানার বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সিকে বুধবার রাতে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তাঁর বিরুদ্ধেও খুনের মামলায় দায়ের হয়েছে।
এর আগে সাবেক শিক্ষা তথা পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, হাসিনার বেসরকারি শিল্প উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, প্রাক্তন তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, আওয়ামী লিগের দুই শরিক দলের মন্ত্রী ওয়ার্কাস পার্টির রাশেদ খান মেনন এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের প্রধান হাসানুল হক ইনুকেও খুনের মামলায় গ্রেফতার করেছে বাংলাদেশ পুলিশ। শেষের দু’জনকে বাংলাদেশের সব দলই সজ্জন নেতা হিসাবে মানেন। এখন তাঁদের অভিযোগ, তাঁরা আওয়ামী লিগের সহযোগী ১৪ দলের জোট সঙ্গী।
বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের খবর, ৮ অগাস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লিগের নেতা-কর্মী এবং সাধারণ সমর্থক এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কয়েক হাজার মানুষের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। এমনও অভিযোগ উঠেছে, থানায় গেলে পুলিশ সাদা কাগজে সই করিয়ে নিচ্ছে। তারপর পুলিশই আসামীদের নাম উল্লেখ করে এফআইআর করে নিচ্ছে। একাধিক অভিযোগকারী একান্তে জানিয়েছেন, তিনি যে মামলাকারী সে কথা পুলিশের কাছ থেকে জানতে পেরেছেন। কার বিরুদ্ধে মামলা, কী অভিযোগ কিছুই তিনি জানেনন না।
৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর সারা বাংলাদেশ জুড়ে লুটতরাজ, হামলা, অগ্নিসংযোগের কয়েক হাজার ঘটনা ঘটে বলে অভিযোগ। তখনও টার্গেট করা হয়েছিল মূলত আওয়ামী লিগ সমর্থক ও সংখ্যালঘু শিবিরের লোকজনকে। শুধু খুনের মামলা দিয়েই পুলিশ খান্ত থাকছে না, বেশিরভাগের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সিল করে দেওয়া হয়েছে। ফলে মামলা চালানোর জন্য টাকা-পয়সা তুলতে পারছে না পরিবার। সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে ধৃতদের অনেকের পরিবারের।
হামলায় লাগাম পড়লেও মামলা সন্ত্রাস অতীতের সব নজির ছাপিয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় সংগঠন বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদকের বয়স এখন আশি। ঢাকার একটি থানায় তাঁর বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়েক করা হয়েছে। সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাতারের ঘটনায় সরব হওয়াতেই প্রতিহিংসামূলকভাবে তাঁর বিরুদ্ধে খুনের মামলা দায়েক করা হয়েছে বলে সংগঠনের অভিযোগ।
তবে সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা। বুধবার রাতেও ঢাকায় সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে তিনটি মামলা দায়ের হয়েছে। বুধবার পর্যন্ত বিরুদ্ধে ৮০টি মামলা দায়ের হয়েছে। তারমধ্যে ৭৪টি’ই খুনের মামলা। এরমধ্যে দুটি মামলায় তাঁর মার্কিন প্রবাসী পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়, দিল্লির বাসিন্দা মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল এবং সর্বক্ষণের সঙ্গী বোন রেহানার নাম আছে। বুধবার রাতে ঢাকায় দায়ের হওয়া একটি মামলায় গোটা শেখ ও ওয়াজেদ পরিবারকে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
নির্বিচারে হাসিনা ও তাঁর ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের নিয়ে পাল্টা আওয়াজ উঠেছে। প্রথমে মুখ খুলেছিলেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের জনপ্রিয় ব্যরিস্টার সারা হোসেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা, শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং বাংলাদেশের সংবিধানের রচয়িতা কামাল হাসানের মেয়ে। দু’জনেরই যদিও শেখ হাসিনার চরম বিরোধী বলে পরিচিত। সারা সাংবাদিক বৈঠক ডেকে প্রশ্ন তুলেছেন, মামলা দিয়ে হেনস্থা করার জন্যই কি ছাত্র বিপ্লব হয়েছে? আওয়ামী লিগ যা করছে সেই ধারাই চলছে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে। মামলা নিয়ে ছেলেখেলা হচ্ছে।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বলার চেষ্টা করছেন, মানুষের মধ্যে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ থেকে মামলা দায়ের হচ্ছে। জবাবে সারা বলেছেন, আদালত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা বা ক্ষোভ প্রশমনের জায়গা নয়। কোনও পুলিশ কি প্রমাণ করতে পারবে, এই খুনগুলি শেখ হাসিনা বা তাঁর পরিজনদের নির্দেশে হয়েছে? তিনি নিম্ন আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আবার আওয়ামী লিগ বলছে মামলার পিছনে আছেন স্বয়ং মহম্মদ ইউনুস। তাঁর উপর জামাত, বিএনপি এবং ছাত্র উপদেষ্টাদের চাপ আছে।
বাংলাদেশের জাতীয় দলের ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের বিরুদ্ধে মামলাটি নিয়ে দেশের সব মহলেই জোর চর্চা হচ্ছে। ঢাকার এক পোশাক কর্মী বা দর্জির পুলিশের গুলিতে মৃত্যুর ঘটনায় দেশের হয়ে পাকিস্তান সফরে থাকা সাকিবের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। খুনের ঘটনার দিন সাকিব ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে আঞ্চলিক ক্রিকেট টুর্নামেন্টে খেলছিলেন। সেখান থেকে যান কানাডা। পাকিস্তানে জাতীয় দলের সঙ্গে মিলিত হন কানাডার জাতীয় লিগে খেলা শেষ করে। ওয়াকিবহাল মহলের বক্তব্য, আওয়ামী লিগের সাবেক এমপি হওয়ায় প্রতিহিংসাবশত তাঁর নামে মামলা করা হয়েছে। একই কারণে মামলা হয়েছে অভিনেতা ফিরদৌসের বিরুদ্ধে।
তাৎপর্যপূর্ণ হল, মামলা সন্ত্রাস নিয়ে মুখ খুলতে বাধ্য হয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফকরুল ইসলাম আলমগীর। তাঁর বক্তব্য, উদ্দেশ্যহীনভাবে মামলা দায়ের করে আওয়ামী লিগেরই সুবিধা করে দেওয়া হচ্ছে। মিথ্যা মামলা টিকবে না। আওয়ামী লিগের ১৫ বছরের শাসনের অনেক বিষয় নিয়ে মামলা করার আছে। সে সব খতিয়ে না দেখে শুধু খুনের মামলা দায়ের করা হচ্ছে। এই সব মামলা অর্থহীন।
নির্বিচারের মামলা করা নিয়ে অবশেষে চাপের মুখে মুখ খুলতে বাধ্য হয়েছেন সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলও। তিনি বলেন, সরকার আদালত ও পুলিশের কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। তবে ভিত্তিহীন মামলা না করাই ভাল।
আরও একটি বিষয়ে বাংলাদেশের মানুষ ধীরে ধীরে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। দেখা গিয়েছে, আওয়ামী লিগের নেতা- ও সাবেক মন্ত্রীদের আদালতে তোলার পর তাঁদের উপর জনতা অকথ্য অত্যাচার করছে। কিল-চড়-ঘুষি তো আছেই এমনকী বড় পাথর দিয়ে আঘাত করার ঘটনাও ঘটেছে। সাবেক পররাষ্ট্র তথা শিক্ষা মন্ত্রী দীপু মনিকে আদালত চত্বরে যেভাবে মারধর করা হয়েছে তার নজির বাংলাদেশে নেই।
সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ৭৪ বছর বয়সি এএইচএম শামসুদ্দিন মানিককে আদালতে তোলার সময় এবং তার আগে এমন মারধর করা হয় যে তাঁর অণ্ডকোষে গুরুতর আঘাত লাগে। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করে অপারেশন করাতে হয়। তিনি আওয়ামী লিগের পক্ষে টিভির টক শো-তে বলতেন। এই কারণে তাঁকে লাগাতার হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। বিপদের মুখে সিলেট সীমান্ত দিয়ে ভারতে আসার সময় তিনি গ্রামবাসীদের হাতে ধরা পড়ে যান। ঢাকার এক সাংবাদিকের কথায়, আদালতে ধৃতদের তোলার ভিডিও বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে, পুলিশ-র্যাবের ঘেরাটোপে থাকা আসামীদের একটা সময় জনতার মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। জনতা ইচ্ছে মতো কিল-চড়-ঘুষি মারছে। জুতো ছুড়ছে। তারপর ধৃতদের কোর্ট লকআপে নিয়ে রাখা হচ্ছে। সেখানেও লাগাতার হুমকি দেওয়া হচ্ছে।