শেখ হাসিনা
শেষ আপডেট: 10th August 2024 19:02
পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মূখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য (১৯৪৪-২০২৪) প্রয়াত হয়েছেন। এপারের তরুণ প্রজন্ম বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সম্পর্কে কতটা জানেন আমার জানা নেই। কারণ বর্তমান প্রজন্মের বড় অংশের প্রতিবেশীর খোঁজ-খবর নেওয়ার ফুরসত নেই । ফলে অনেকেই জানেন না যে তিনি বাংলাদেশের একজন অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন।
১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের গঙ্গার জল বন্টন চুক্তি হয়। পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মূখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর পাশাপাশি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও সেই চুক্তির ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। ভারতের ফেডারেল কাঠামোয় এ রকম কোন চুক্তি করতে হলে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। জ্যোতি বসু গঙ্গা জল চুক্তিতে সায় না দিলে এপার বাংলা বিপাকে পড়ত। তখন আমি যতদূর জেনেছি, ভারতের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে জলচুক্তির বিষয়ে সহায়তা করেছিলেন জ্যোতি বসু। তাঁর আগে তিনি এবং বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। জ্যোতি বসুর তো পৈত্রিক বাড়ি বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও-এ বারদি গ্রামে।
মূখ্যমন্ত্রী হিসেবে জ্যোতি বসুর দায়িত্ব ছাড়ার পর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তাঁর স্থালাভিষিক্ত হন। এই সময় তিনি তিস্তার জল বন্টন চুক্তির একটি খসড়া অনুমোদন করেছিলেন। অর্থাৎ তিস্তার জল বাংলাদেশের সঙ্গে ভাগ করে নিতে তাঁর আপক্তি ছিল না।
কিন্তু সেই চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার আগেই ২০১১ সালের নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘ ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট শাসনের অবসান ঘটে। নির্বাচনে জিতে আসেন মমতা বন্দ্যাপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস। ২০২৬ সালে গঙ্গার জল বন্টন চুক্তি নবায়ন হওয়া কথা। আর তিস্তার জল বন্টন চুক্তি ২০১২ সালের পর আর আলোর মুখ দেখেনি। কারণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তা চান না। তিনি রাজ্যের স্বার্থে ভিন্ন অবস্থান নিয়েছেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই দুই চুক্তির ভবিষ্যৎ তেমন একটা পরিষ্কার নয়।
ওপার বাংলায় দেখেছি সম্মানিত বা গুরুজন স্থানীয় ব্যক্তিদের নামের সঙ্গে ‘দা’ (দাদা) অক্ষরটি যোগ করতে। বিশ্বভারতীর শিক্ষকদের তো বটেই খোদ উপাচার্যকে শিক্ষার্থীদের এই ভাবে সম্বোধন করতে দেখেছি। অবশ্য বর্তমানে অনেক জায়গায় ‘স্যার’ ডাকার প্রচলন শুরু হয়েছে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে অনেকেই ‘বুদ্ধদা’ বসে সম্মোধন করতেন। আজীবন মার্কসবাদী রাজনীতি করেছেন। ছিলেন সিপিএমের পলিটব্যুরোর সদস্য। বাংলাদেশের রাজনীতি সচেতন মানুষ, লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবী মহল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে চিনতেন, জানতেন। কারও কারও ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল। বাকিরা তাঁকে জানতেন তাঁর বিশেষ গুণাবলীর জন্য। এই তালিকায় ভারতে কাজের সূত্রে যাওয়া কূটনীতিকেরাও আছেন। যাঁদের কথায় মানুষটির প্রতি বাড়তি শ্রদ্ধা প্রকাশ পেত।
আমি যতটা বুঝেছি, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সনাতন মাকর্সবাদীদের চেয়ে চিন্তাধারায় কিছুটা পৃথক ছিলেন। সনাতনীরা জনমানুষের উন্নয়ন সম্পদের সুষম বন্টন চান ঠিকই, তবে তারা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়েও যে এই সব জনবান্ধব কাজ করা যায় তা মেনে নিতে চান না। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এই সনাতন ধারা থেকে বের হয়ে উন্নয়নের নূতন কাঠামো নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। তিনি জানতেন কৃষি জমি যা উৎপাদন করতে পারে তার একটা সীমাবদ্ধতা আছে যা ক্রমবর্ধমান যোগানের সঙ্গে তাল মেলাতে পারে না। তা হতে পারে ভোক্তা সন্তষ্টি বা কিঞ্চিৎ বেকারত্ব দূরকরা।
মূখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করার সময় তিনি রাজ্যের কলকারখানা স্থাপনের জন্য টাটা-বিড়লার মতো বড় বড় বিনিয়োগকারীদের রাজ্যে বিনিয়োগ করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু কলকারখানার জন্য চাষের জমি নিয়ে নেওয়া হচ্ছে, অভিযোগ তুলে আপত্তি তোলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। তাঁর এক কথা, কৃষি জমি ব্যবহার করে তিনি রাজ্যে শিল্প কারখানা চান না। ২০১১ সালের নির্বাচনে মমতার শিল্পের জন্য কৃষি জমি রক্ষার দাবির সামনে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। রাজ্যের অর্থনীতির লাভ-ক্ষতির বিষয়টি পশ্চিমবঙ্গের মানুষের বিচার্য।
একজন রাজনীতিবিদ বা জননেতাকে মানুষ খারাপ বা ভাল অনেক কাজের জন্য মনে রাখে । কিংবদন্তী তূল্য বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে তাঁর রাজনৈতিক সতীর্থদের পাশাপাশি আরও অনেকে মনে রাখবেন। ব্যক্তিগত পরিচয়ে তিনি বাংলা সাহিত্যে অমর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভ্রাতুষ্পুত্র ছিলেন। পার্টি ও প্রশাসনের কাজের চাপের মধ্যেও কবিতা উপন্যাস, গল্প, নাটক, সিনেমা থিয়েটার নিয়ে সময় কাটাতেন।
আজীবন রাজনীতি করা মানুষটির সততা ছিল প্রশ্নাতীত। আমরাও জানি, কলকাতার পাম এভেনিউয়ের দু’রুমের একটি বাসায় কী অতি সাধারণ জীবন কাটিয়েছেন মানুষটি। ওই বাড়িটিতে যাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়নি। তবে অনেক বছর আগে পশ্চিমবঙ্গের দু’একজন পরিচিত নেতা-মন্ত্রীর বাড়িতে যাওয়ার সৌভ্যাগ্য আমার হয়েছিল। তাদের সাধারণ জীবনযাত্রা অবাক করেছিল আমাদের রাজনীতিবিদদের জীবনযাপনের জৌলুস দেখে।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আরও যে দিকটি অবাক করেছিল, ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে পরাজয়ের পর অসুস্থ শরীরেও তিনি পার্টির প্রতি তাঁর কর্তব্য করে গিয়েছেন। কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে সিপিএমের জনসভার ঘটনাটি এপারেও চর্চা হয়েছিল। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নাকে অক্সিজেনের নল নিয়ে সভাস্থলে উপস্থিত হন। শারীরিক দুর্বলতার নামতে না পারায় শেষ চেষ্টা করেন গাড়িতে শুয়ে বক্তৃতা দিতে। তাও সম্ভব হয়নি। সেদিন অনেক মনকষ্ট নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন।
সব শেষে বলি, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য রাজনীতিতে দ্রুত সংকুচিত হওয়া শুদ্ধ রাজনীতিবিদদের একজন। তিনি চলে যাওয়ায় এই শূন্যতা আরও বেড়ে গেল।
লেখক: সাবেক চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন