শেষ আপডেট: 3rd January 2025 17:15
অবশেষে বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসাবে সরকারি স্বীকৃতি পেলেন কাজী নজরুল ইসলাম। অন্তর্বর্তী সরকারের জারি করা নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, ১৯৭২ সালের ৪ মে থেকে এই স্বীকৃতি কার্যকর হবে। কবি প্রয়াত হন ১৯৭৬ সালের ২৯ অগাস্ট। অর্থাৎ জাতীয় কবি হিসাবে মরণোত্তর স্বীকৃতি মিলল তাঁর।
সরকারি অনুষ্ঠানে যদিও তাঁকে জাতীয় কবি বলে উল্লেখ করেই শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হয়ে আসছিল। বহু সরকারি প্রতিষ্ঠানের নামের গোড়াতেও ‘জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম লেখা। কিন্তু তাঁকে জাতীয় কবি ঘোষণা করে কোনও প্রজ্ঞাপন বা বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়নি এতদিন। কেন হয়নি, সরকার কোনও বিজ্ঞপ্তি জারি করবে কি না, এই সব বিষয় উল্লেখ করে বাংলাদেশের হাইকোর্টে ২০২২ সালে মামলা হয়েছিল। কাজী নজরুল ইসলামকে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় কবি ঘোষণায় গেজেট প্রকাশ করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে আদালতের তরফে নোটিস জারির নির্দেশ দেন হাইকোর্টের তৎকালীন দুই বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের ডিভিশন বেঞ্চ।
বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক সচিব, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ও নজরুল ইনস্টিটিউটের কার্যনির্বাহী পরিচালককে আদালতে হলফনামার মাধ্যমে সরকারের বক্তব্য জানাতে বলা হয়েছিল। তারপর বিষয়টি সরকারের বিবেচনায় থাকলেও আনুষ্ঠানিক বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়নি।
এই ব্যাপারে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের দশ আইনজীবী হাইকোর্টে মামলা করেছিলেন। তাঁদের একজন মহম্মদ আসাদউদ্দিনের বক্তব্য, দেশের আপামর জনগণ জানে বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। কিন্তু বাস্তবে এই মর্মে কোনও দলিল নেই। মৌখিকভাবে তিনি জাতীয় কবি হিসেবে পরিচিত হলেও লিখিতভাবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।
ভারতের নজরুল কীভাবে বাংলাদেশের জাতীয় কবি হলেন?
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ জন্ম নেওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমান ভারত সরকারের কাছে আর্জি জানান, কবি নজরুল ইসলামকে তাঁরা সে দেশে নিয়ে যেতে চান। কবি পরিবারের সম্মতি নিয়ে সবুজ সংকেত দেয় ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। ১৯৭২-এর ৪ মে কবি সপরিবারে বাংলাদেশ যান। তেজগাঁও বিমান বন্দরের বাইরে সেদিন তিল ধারনের জায়গা ছিল না। স্বাধীনতার লড়াইয়ে যে কবির গান, কবিতা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা জুগিয়েছে, তাঁকে পেয়ে সদ্য স্বাধীন দেশের জনতা আবেগ, উচ্ছ্বাসে ভেসে যায় সেদিন। সেদিনই রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে কবিকে দেখতে যান। নজরুলকে জাতীয় কবি ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী মুজিবুর।
বাংলাদেশে কেমন ছিল কবির জীবন?
ঢাকার ধানমণ্ডি এলাকায় কবির জন্য বরাদ্দ হয় সরকারি বাড়ি। মুজিবুর বাড়িটির নাম দেন ‘কবি ভবন’। নজরুলকে জাতীয় কবি ঘোষণাতেই থেমে থাকেনি সরকারি আয়োজন, রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় নজরুলের দেখভালের ব্যবস্থা হয়। গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ভবনের মতো ওই বাড়িতেও প্রতিদিন জাতীয় পতাকা উড়ত। পরে তাঁকে নাগরিকত্ব এবং বাংলাদেশের অসামরিক সম্মান ‘একুশে পদক’ দিয়ে সম্মান জানায় সে দেশের সরকার। কিন্তু জাতীয় কবি ঘোষণা সংক্রান্ত কোনও সরকারি বিজ্ঞপ্তি ছিল না।
‘জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান’, এই মর্মেও দীর্ঘদিন কোনও বিজ্ঞপ্তি ছিল না।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার কাণ্ডারি শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর দেশ জাতির পিতা মর্যাদা দিয়েছে। এই ব্যাপারেও বহু বছর সরকারি বিজ্ঞপ্তি ছিল না। মুজিব কন্যা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানেই ‘জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান’ লাইনটি যুক্ত করেন। ফলে শেখ মুজিবরের ক্ষেত্রে আলাদা করে আর সরকারি বিজ্ঞপ্তি জারির প্রয়োজন নেই। যদিও বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জানিয়েছে তারা মুজিবকে জাতির পিতা বলে মানে না।
নজরুলকে নিয়ে কী বলছে বাংলাদেশ সরকার? সরকারি গেজেট বিজ্ঞপ্তি বা প্রজ্ঞাপন না থাকলেও জাতীয় কবি হিসেবে একাধিক নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে। নামের আগে জাতীয় কবি শব্দ দুটি যুক্ত করে একটি আইনও আছে বাংলাদেশে। সেটি হল ‘জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০০৬।’
‘কবি নজরুল ইনস্টিটিউট আইন, ২০১৮’-এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে ‘কবি’ অর্থ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। একই ভাবে বিদ্যালয়ের পাঠ্যবইয়ে, অন্যান্য বইপুস্তকে, গবেষণাকর্মে, পত্রপত্রিকায়, সভাসমাবেশে সর্বত্রই কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি বলেই উল্লেখ করা হয়। কিন্তু এসবই ছিল পরোক্ষ স্বীকৃতি।