শেষ আপডেট: 6th February 2025 13:13
বাংলাদেশের বয়স মাত্র ৫৪। দেশটির বয়সের তুলনায় ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ দিবস সংখ্যায় খানিক বেশিই বলা চলে। ১৯৭১-এই আছে পাঁচটি বিশেষ দিন—৭ মার্চ শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক ভাষণ—এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যা ‘অপারেশন সার্চলাইট’, যে হত্যাকাণ্ডে মাত্র কয়েক চার-পাঁচ ঘণ্টায় কয়েক হাজার বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছিল। সে দিনই গভীর রাতে গ্রেফতার করা হয় শেখ মুজিবুর রহমানকে। রাত ১২’টার পর, সরকারিভাবে ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দেন শেখ মুজিব। সে বছর ১০ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঘোষণা হয় এবং সাতদিনের মাথায় ১৭ এপ্রিল কারাগারে থাকা শেখ মুজিবকে ‘রাষ্ট্রপতি’ ঘোষণা করে শপথ নেয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিসভা।
নয় মাসের যুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর আসে বিজয়। দিনটি পালিত হয় বিজয় দিবস হিসাবে। তালিকায় পঞ্চম দিনটি অত্যন্ত শোকের। ১৯৭৫-এর ১৫ অগাস্ট ঢাকার ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িটিতে সপরিবারে হত্যা করা হয় দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবর রহমানকে।
স্বাধীনতা পরবর্তী বিগত ৫৪ বছরে বাংলাদেশ অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। ১৯৮১-র ৩০ মে বিক্ষুব্ধ সেনাকর্তাদের ষড়যন্ত্রে খুন হন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। গত বছর, অর্থাৎ ২০২৪-এর জুলাই-অগাস্টের ঘটনাবলী, বিশেষ করে ৫ অগাস্টের গণঅভ্যুত্থানও ইতিহাসের অংশ। যে গণ-বিপ্লবের প্রাপ্তি বাংলাদেশের মানুষ বিগত ছয় মাস ধরে উপলবব্ধি করছেন। তাতে সর্বশেষ সংযোজনটি গতকাল বুধবার অর্থাৎ ৫ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া ঘটনাবলী।
ঢাকায় ধানমন্ডির ৩২ নন্বর বাড়িটি ভাঙা শুরু হয়েছিল বুধবার রাতে। বৃহস্পতিবার সকালেও তা চলছে। হচ্ছে। পুলিশ-সেনা নির্বিকার। বুধবার রাতে বাড়িটি ভাঙা শুরু হলে সেনা বাহিনীর একটি দল সেখানে গেলেও ‘বিপ্লবী ছাত্র-জনতা’ তাদের ধাওয়া করে। প্রাঁণ বাঁচাতে সেনাও সরে যায়। ফলে বিনা বাধায় বা়ড়িটি ভাঙছে উম্মত্ত জনতা।
ইতিহাসে শুধু গৌরবজ্বল নয়, স্থান হয় অন্ধকারাচ্ছন্ন দিনগুলিরও। ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫-ও সেই কারণে ঐতিহাসিক দিনের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবে। ধানণ্ডির ৩২ নন্বর বাড়িটি যারা গুঁড়িয়ে দিলেন তারা নিশ্চয়ই আগামী বছর থেকে দিনটি পালন করবেন বাংলাদেশের বুকে পাকিস্তানের বিজয় দিবস হিসাবে।
মুক্তিযুদ্ধ, তারও আগে অন্তত তেরো-চোদ্দ বছর ওই বাড়িটিই ছিল বাংলাদেশের আঁতুরঘর। পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ববাংলার প্রতি বঞ্চনার প্রতিবাদে সংগ্রাম, অসহযোগ এবং শেষে স্বাধীনতা তথা মুক্তির আন্দোলনের রূররেখা তৈরি হয়েছিল ওই বা়ড়িটিতে। তাই পাকিস্তানের সেনা ও প্রশাসনের বরাবর নিশানায় ছিল ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িটি। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ গভীর রাতে এই বাড়ি থেকে শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় পাক সেনারা। সেদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত ওই বাড়িতে সহযোদ্ধাদের সঙ্গে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছিলেন শেখ মুজিব। ৭ মার্চের ভাষণ দিতে গিয়েছিলেন এই বাড়ি থেকেই।
২৫ মার্চ গ্রেফতারের সেই রাতে স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা, বড় মেয়ে শেখ হাসিনা-সহ মুজিবের গোটা পরিবার ওই বাড়িতেই ছিল। পাক সেনারা তাঁদের উপর চড়াও হয়নি। এমনকী বাড়িটিতে তল্লাশি করেছে বলেও শোনা যায়নি। যদিও তাদের ছোড়া গুলিতে বাড়িটির সামান্য ক্ষতি হয়েছিল। ৭৫-এ মুজিব হত্যার দিনে আঘাত এসেছিল বাড়িটির উপর। তৃতীয় হামলাটি হয়েছিল ১৯৮৯-এর ১০ অগাস্ট রাতে। শেখ হাসিনা ওই রাতে পৈত্রিক বাড়িতে ছিলেন। তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে বোমা ও গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়েছিল।
তবে সেগুলি ছিল নিছকই কিছু ঘটনা সংশ্লিষ্ট। আসল বিপদ অন্য। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বিকালে ঢাকায় পাকসেনার আত্মসমর্পণের পর থেকে পাকিস্তানের নিশানায় ছিল ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িটি। পাক কর্তাদের এই বাসনা বয়ে বেড়াতেন, ওই বাড়িটি ধূলিসাৎ করে একদিন যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ তুলবে। সেদিক থেকে ৫ ফেব্রুয়ার, ২০২৫-এর রাতে বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানের সেই আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়েছে বলা চলে। বাংলাদেশে যাদের বাসনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ হল তারা নিশ্চয়ই চোখ বুজলে দেখতে পা্চ্ছেন, ৩২ নন্বর ধানমণ্ডির বঙ্গবন্ধু ভবনে পাকিস্তানের পতাকা উড়ছে।
বাড়িতে তিনবার যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। দুর্ভাগ্য হল, বুধবার রাতে টিভির পর্দায় প্রত্যক্ষ করতে হল কীভাবে সেই ভবনে আগুন দিয়ে, কোদাল, শাবলের আঘাতে গুঁড়িয়ে ভাঙা হচ্ছে। সঙ্গে চলছে উল্লাস, উদযাবন। কয়েক বছরের ব্যবধানে তিনবার গেলেও প্রতিবারই অনুভূতি ছিল অভিন্ন। মনে হয়েছিল, পৃথিবীরে কোনও কসাইয়ের জন্ম হয়নি, জন্ম নেবেও না, ওই বাড়িতে গেলে যার চোখ বেয়ে দু-ফোঁটা জল গড়াবে না। বুধবার রাতে বুঝলাম, কী মস্ত ভুলের স্বর্গে বাস করি।আরও একটি মুক্তিযুদ্ধই পারে সেই ভুল শোধরাতে।