শেষ আপডেট: 29th January 2025 18:43
দ্য ওয়াল ব্যুরো: বুধবার ভোর রাতে মহাকুম্ভে ঘটে যাওয়া মহা বিপর্যয়ে মৃতের সংখ্যা এখনও সামনে আসেনি সরকারি ভাবে। তবে জানা যাচ্ছে, অন্তত ১৫ জনের প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে। আর এই ঘটনায় বারবার উঠে আসছে, মহাকুম্ভ মেলার সবচেয়ে পবিত্র স্থান ‘সঙ্গম নাক’-এর (Sangam Nose) কথা। এইখানেই ভয়াবহ ভিড়ের চাপে পদপিষ্ট হয়ে পুণ্যার্থীদের মৃত্যু হয়েছে। বহু মানুষ আহত হয়েছেন ও অনেকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন।
ইংরেজিতে এই ‘সঙ্গম নোজ’ বা সঙ্গম নাক হল আসলে, গঙ্গা, যমুনা ও পৌরাণিক সরস্বতী নদীর সঙ্গমস্থলের চূড়ান্ত বিন্দু। অর্থাৎ ঠিক যেই বিন্দুতে এই তিনটি নদীর মিলন ঘটছে, সেটিকেই বলা হচ্ছে ‘নাক’।
মৌনী অমাবস্যার দিন, যা কুম্ভ মেলার সবচেয়ে শুভ দিন হিসেবে বিবেচিত, লাখ লাখ ভক্ত সেই সঙ্গম-বিন্দুতেই পবিত্র স্নানের জন্য ভিড় জমান। মধ্যরাত থেকে শুরু হওয়া এই ধর্মীয় আচারচরণের সময় হাজার হাজার পুণ্যার্থী একসঙ্গে নির্দিষ্টি সেই সঙ্গম বিন্দুর দিকে স্রোতের মতো ছুটে যান, তখনই চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়, ব্যারিকেড ভেঙে যায় এবং পদপিষ্টের ঘটনা ঘটে।
এই কারণে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ পদপিষ্টের ঘটনার পরপরই ভক্তদের উদ্দেশে আবেদন করেন যেন তাঁরা শুধু ‘সঙ্গম নোজ’-এর দিকেই না যান, বরং তাঁদের কাছাকাছি যে কোনও ঘাটে গিয়ে স্নান করেন।
সঙ্গম নাক বা এই নির্দিষ্ট বিন্দু হল, ত্রিভুজাকৃতির একটি ছোট ভূখণ্ড, যা উত্তরে গঙ্গা ও দক্ষিণে যমুনার মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। এখানেই এই দুটি নদী পৌরাণিক সরস্বতী নদীর সঙ্গে মিলিত হয় বলে হিন্দু ধর্মে এটি অত্যন্ত পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত।
ধারণা করা হয়, এই নির্দিষ্ট স্থানে স্নান করলে এ জন্মের সমস্ত পাপ ধুয়ে যায় এবং পুনর্জন্মের বন্ধন থেকেও মুক্তি পাওয়া যায়। প্রতি ১৪৪ বছর পর একবার অনুষ্ঠিত মহাকুম্ভে এই স্নান আরওই বিশেষ হয়ে ওঠে। আর মৌনী অমাবস্যার মতো শুভ মুহূর্তে এই স্নানের এতই মাহাত্ম্য বলে বিশ্বাস করা হয়, যে এতে আত্মিক মুক্তি লাভের সম্ভাবনা চূড়ান্ত বলেই বিশ্বাস করা হয়।
প্রয়াগরাজের বিখ্যাত জ্যোতিষী পণ্ডিত রমেশ পাণ্ডে এই নিয়ে বলেছেন, ‘হিন্দু ধর্মমতে, সঙ্গম বিন্দুতে স্নান করলে মোক্ষ লাভ হয়। এ কারণেই প্রতিটি ভক্তই এখানে এসে স্নান করতে চান।’
মহাকুম্ভ ২০২৫-এর মেলার তথ্য বলছে, মেলা শুরুর দিন থেকে প্রতি ঘণ্টায় গড়ে প্রায় ৩ লাখ ভক্ত সঙ্গম বিন্দুতে স্নান করেছেন। এই সংখ্যা ১৩ জানুয়ারি পৌষ পূর্ণিমা ও ১৪ জানুয়ারি প্রথম ‘অমৃত স্নান’-এর দিনেও এমনই ছিল। ২৯ জানুয়ারি মৌনী অমাবস্যায় এটি দ্বিতীয় ‘শাহি স্নান’ ছিল, যেখানে বিশাল সংখ্যক সাধু-সন্ত ও পুণ্যার্থী সমবেত হন।
আগামী ৩ ফেব্রুয়ারি বসন্ত পঞ্চমীর দিন তৃতীয় ও শেষ ‘শাহি স্নান’ অনুষ্ঠিত হবে। এই স্নানের দিনগুলো ছাড়াও, আরও তিনটি গুরুত্বপূর্ণ স্নানের দিন রয়েছে, যেগুলোতে ভক্তদের ঢল নামে।
কুম্ভ মেলার জন্য মোট চার হাজার হেক্টর জায়গা বরাদ্দ করা হয়েছে, যেখানে গঙ্গা ও যমুনার দুই তীরজুড়ে বিভিন্ন স্নানের ঘাট তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে অধিকাংশ পুণ্যার্থী সঙ্গম বিন্দুতেই যেতে চান।
সে জন্য মহাকুম্ভ ২০২৫ শুরুর আগেই উত্তরপ্রদেশ সরকার সঙ্গম নোজের পূর্ব দিকের সীমানা প্রসারিত করে আরও ২৬ হেক্টর জায়গা যোগ করেছে।
সরকারের লক্ষ্য ছিল শাহি স্নানগুলোর সময় একসঙ্গে ২ লাখ ভক্ত যেন প্রতি ঘণ্টায় স্নান করতে পারেন। মহাকুম্ভ ২০১৯-এর সময় যেখানে প্রতি ঘণ্টায় ৫০,০০০ ভক্ত স্নান করতেন, এবার সেটি চার গুণ বাড়ানো হয়েছে।
গঙ্গার উপর শাস্ত্রী ব্রিজ থেকে সঙ্গম নোজ পর্যন্ত ১,৬৫০ মিটার এলাকাজুড়ে বালির বস্তা ফেলে নতুন ঘাট তৈরি করা হয়েছে, যাতে আরও বেশি মানুষ স্নান করতে পারেন।
এর পরেই ঘটে গিয়েছে বিপদ।
সঙ্গম নোজের প্রতি অসংখ্য ভক্তের আকর্ষণ, সঙ্গে পর্যাপ্ত নিয়ন্ত্রণের অভাব—এ দুইয়ের সমন্বয়েই বুধবার ভোরে ভয়াবহ দুর্ঘটনাটি ঘটে।
মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে চারবার ফোন করে পরিস্থিতির আপডেট দিয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং বিজেপি সভাপতি জেপি নাড্ডাও নিয়মিত খবরাখবর নিচ্ছেন।
উত্তরপ্রদেশ প্রশাসন ইতিমধ্যেই একাধিক পদক্ষেপ করেছে, যেমন মাইকিং ও প্রচারের মাধ্যমে ভক্তদের নিকটবর্তী ঘাটে স্নানের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে, হেলিকপ্টারের মাধ্যমে গোটা এলাকা পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে, অতিরিক্ত ভিড় নিয়ন্ত্রণে নতুন করে ব্যারিকেড বসানো হয়েছে, মেলাজু়ে পুলিশি তৎপরতা আরও বাড়ানো হয়েছে।
সঙ্গম বিন্দুর ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় গুরুত্বের কারণে এখানে ভক্তদের ঢল নামাই স্বাভাবিক। কিন্তু জনসংখ্যার বিশাল চাপ সামলাতে প্রশাসনের আরও সুসংগঠিত ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন ছিল বলেই মনে করছেন বিরোধীরা। সবচেয়ে বড় কথা হল, মহাকুম্ভ ২০২৫-এর এখনও অনেকগুলো দিন বাকি আছে, আরও দুটি বড় স্নানের দিনও আছে সামনে। প্রশাসন যদি কঠোর পদক্ষেপ না করে, তবে এমন বিপদ ফের ঘটতে পারে।