শেষ আপডেট: 29th November 2023 12:02
দ্য ওয়াল ব্যুরো: ২০১৯ সাল। মেঘালয়ের অবৈধ ‘ইঁদুরগর্ত’ খনিতে নেমে আটকে পড়েছিলেন কয়েকজন শ্রমিক। তাঁদের উদ্ধার করতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয় উদ্ধারকারী দলকে। টানা কয়েকদিন ধরে চলে হইচই। মাস না যেতেই পশ্চিমবঙ্গে বাঁকুড়ার বড়জোড়ার বাগুলি গ্রামে সেই একই ঘটনা ঘটে। চটজলদি খনিগর্ভে নামতে ছোট ছোট ইঁদুরগর্ত খনি মুখ দিয়ে ভেতরে নেমে অন্ধকার সুড়ঙ্গে হারিয়ে যান শ্রমিকরা। পূর্ব জয়ন্তিয়া পাহাড়ের সাড়ে তিনশো ফুট নীচ থেকে আর উদ্ধার করা যায়নি তিন খনি শ্রমিককে। বাংলায় আসানসোল, রানিগঞ্জের খনিগুলোতে এই অবৈধ ইঁদুরগর্ত মানেই আতঙ্ক। পেট চালানোর তাগিদে বিপজ্জনকভাবে ছোট ছোট গর্ত খুঁড়ে খনিতে নেমে কয়লা চুরি আকছারই চলে। আর তার ফলে খনিতে প্রায়ই ধস নেমে বিপদ ঘটে। তবে উত্তরকাশীতে শ্রমিকদের সুড়ঙ্গ থেকে বের করতে যেখানে বিদেশি যন্ত্রও ব্যর্থ হয়েছে, সেখানে এই ইঁদুরগর্ত পদ্ধতি বা র্যাট হোল মাইনিং (Rat Hole mining) কাজে আসে।
ছোট ছোট খোপের পাশে খোঁড়া হয় কুয়ো, বাংলায় একে বলে ‘ডুকি’
মাটির বহু নীচে ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ খনি থেকে কয়লা যেমন তোলা হয়, তেমনই হয় ‘ওপেন কাস্ট প্যাচ’ বা খোলামুখ খনি থেকে। একশো-দু’শো ফুট মাটি সরিয়ে কয়লার স্তরের একটা অংশ উন্মুক্ত করা হয়, সেখান থেকে কয়লা তুলে নিয়ে আসা হয়। চটজলদি খনিগর্ভে পৌঁছতে খনির গায়ে অনেক ছোট ছোট গর্ত বা খোপ খোঁড়া হয়। দুই শতাব্দী ধরে আসানসোল রানিগঞ্জের ভূগর্ভে এ রকম ফাঁপা অসংখ্য খোপ তৈরি হয়েছে। কিছুটা বিজ্ঞানসম্মত ভাবে, অনেকটাই অবৈজ্ঞানিক ভাবে। মাটি ধসে যাওয়া ও পুরনো খনিতে আগুন লাগা এখানকার নিত্য সমস্যা। এই ছোট ছোট খোপগুলিই বর্ষাকালে বিপদের কারণ হয়ে ওঠে। অহরহ ধস নামতে থাকে খনিতে।
এই ছোট ছোট খোপগুলিকেই স্থানীয়রা বলেন ইঁদুর গর্ত। খুব সরু গর্ত করে নীচের দিকে এগিয়ে যাওয়া হয়। অনেক সময় গর্ত এতটাই সরু হয় যে একজন মাত্র সেই গর্তে নামতে পারেন। টানেল সরু হওয়ায় অনেকসময় সেখানে নামে মহিলা ও শিশুরাও। এরপর ছোট গাঁইতি গিয়ে খুঁড়ে কয়লা বের করা হয়। এই প্রক্রিয়া দুভাবে হয়, আনুভূমিকভাবে গর্ত খুঁড়ে ধীরে ধীরে নীচে নামা হয়। আর দ্বিতীয়টি হল ১০-১০০ বর্গ মিটার গর্ত খোঁড়ার পর সেখান থেকে আরও ১০০-৪০০ ফুট কুয়ো খোঁড়া হয়।
মেঘালয়ে জয়ন্তিয়া পাহাড়ে ইঁদুরগর্ত খনি
আসানসোল খনি অঞ্চলের নিরন্ন আদিবাসী ও তফসিলি মানুষের জীবন-মরণের তোয়াক্কা না করেই এইসব গর্ত খুঁড়ে বা গর্ত খুঁজে অবলীলায় নেমে পড়েন খনিতে, খনির ম্যাপ ছাড়াই, ফেলে রাখা কয়লার খোঁজে। কোন শাবলের ঘায়ে কতটা বিপদ তার হিসেব থাকে না। আর গর্তের পাশে ওই কুয়োগুলোকে বলা হয় ‘ডুকি’। নড়বড়ে কপিকলের ডুলিতে দু’-তিনশো ফুট গভীরে নীচে গিয়ে কয়লা তুলে আনা হয়। আসানসোল-রানিগঞ্জের দামোদর অজয়-সংলগ্ন বহু গ্রামে ‘ডুকি’র গোপন ব্যবহার চলছে।
উত্তরকাশীতে ইঁদুরগর্ত খুঁড়তে বিশেষজ্ঞ টিমকেই নিয়ে আসা হয়। টিমের সদস্যরা বলছেন, তাঁরা র্যাট হোল মাইনার নন, তবে এই পদ্ধতিতে গর্ত খোঁড়ার প্রক্রিয়া জানেন। সিল্কিয়ারা টানেলে যখন সব যন্ত্রপাতিই হাল ছেড়ে দেয়, তখন এই প্রক্রিয়াই কাজে লাগানো হয়। ইঁদুরগর্ত খুঁড়তে দক্ষ ২৯ বছরের মুন্না কুরেশিই পদ্ধতি বলেন। তিনি দিল্লির একটি সংস্থার হয়ে কাজ করেন। তাঁর নির্দেশেই দুজন করে শ্রমিক লাগানো হয় ছোট ছোট খোপ খুঁড়তে। একজন কোদাল, গাঁইতি দিয়ে মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে গর্ত তৈরি করেন, অন্যজন মাটি-পাথর তুলে বাইরে ফেলে দিয়ে আসেন। এইভাবে ছোট ছোট অসংখ্য খোপ তৈরি হয়। সেই পথেই মঙ্গলবার সন্ধে সাড়ে ৭টা নাগাদ প্রথম শ্রমিককে বের করে আনা হয়। এর পরে বাকি ৪০ জনকে বের করা হয়।
২০১৪ সালে ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনাল (এনজিটি) ব়্যাট হোল মাইনিং পদ্ধতিকে নিষিদ্ধ করে। ২০১৫ সালেও এই নিষেধাজ্ঞা বহাল ছিল। বাংলায় শুধু নয় মেঘালয়তেও এই পদ্ধতিতে বেআইনিভাবে কয়লা তোলা হয় খনি থেকে।