শেষ আপডেট: 24th February 2024 22:10
দ্য ওয়াল ব্যুরো: ব্রিটিশ আমলের অপরাধ আইন বদলে কেন্দ্রীয় সরকার তিনটি নতুন আইন পাশ করিয়েছে সংসদে। আইন তিনটি হল, ভারতীয় ন্যায় সংহিতা (বিএনএস), ২০২৩, ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা (বিএনএসএস) ২০২৩ এবং ভারতীয় সাক্ষ্য আইন (বিএস), ২০২৩। তাৎপর্যপূর্ণ। আইন তিনটির ক্ষেত্রে ‘ইন্ডিয়া’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি, যা ব্রিটিশ আইনে ছিল। গত বছর সেপ্টেন্বর থেকে কেন্দ্রীয় সরকার ইন্ডিয়া’র পাশাপাশি ইংরিজি’তেও ‘ভারত’ কথাটি ব্যবহার শুরু করেছে। আলোচ্য আইন তিনটিতেও ইংরিজিতেও ভারত, ভারতীয় শব্দগুলি ব্যবহার করা হয়েছে। তবে বিরোধী দল এবং আইনজ্ঞমহলের একাংশের আইন তিনটি নিয়ে আপত্তির কারণ সেটা নয়। আপত্তি, বিবাদের কারণ, আগের আইনের গুরুত্বপূর্ণ ধারা বাতিল এবং সাজার মেয়াদ বৃদ্ধি, নানা ক্ষেত্রে অপরাধের নয়া সংজ্ঞাকেও নাগরিক অধিকার হরণের দায়ে অভিযুক্ত করা হচ্ছে।
যেমন, ভারতীয় ন্যায় সংহিতা বিলে ব্রিটিশ আমল থেকে এখনও চালু ভারতীয় দণ্ডবিধির ২২টি ধারা বাতিল করা হয়েছে। পরিবর্তন করা হয়েছে ১৭৫টি বর্তমান ধারার। এখনও চালু ভারতীয় দণ্ডবিধিতে ২৬টি অধ্যায়ে মোট ৫৭৬টি ধারা ছিল। নতুন বিলে ১৯টি অধ্যায়ে ৩৫৬টি ধারা বা ক্লজের কথা বলা হয়েছে।
ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতায় ফৌজদারি কার্যবিধির ৯টি বিধান বাতিল এবং ১৬০টিতে পরিবর্তন করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। এছাড়া যুক্ত হয়েছে ৯টি নতুন বিধান।সব মিলিয়ে তাতে ৫৩৩টি ধারা আছে।
ভারতীয় সাক্ষ্য আইনের ক্ষেত্রে বর্তমান ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্টের ৫টি বিধান বাতিল এবং ২৩টি বিধানে পরিবর্তন করেছে সরকার। এ ছাড়াও ১টি নতুন বিধান যুক্ত করা হয়েছে। এই আইনে মোট ১৭০টি ধারা আছে।
নয়া ভারতীয় ন্যায় সংহিতা আইনের বেশ কিছু ধারা নিয়ে নানা মহলের আপত্তি আছে। তারমধ্যে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের সংজ্ঞা নিয়ে অনেকেই আপত্তি তুলেছেন। কারণ তাতে ‘পাবলিক অর্ডার’ শব্দ দুটি যোগ করা হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলি এবং বিরোধী নেতাদের অনেকের আশঙ্কা অদূর ভবিষ্যতে জন আন্দোলনও এই ধারার অধীনে অপরাধ হিসাবে গন্য হতে পারে। তাদের বক্তব্য, শ্রমিকরা বেতনের দাবিতে, সাধারণ মানুষ কোনও দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন করলে জনজীবন বা পাবলিক অর্ডার বিঘ্নিত হতে পারে। সরকার এই সব ক্ষেত্রে পরিস্থিতি সামাল দিয়ে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের তকমা দেবে না, এমন কথা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল।
সুপ্রিম কোর্ট ফৌজদারি দণ্ডবিধির রাষ্ট্রদ্রোহের ধারাটি বাতিল করলেও সেটি নাম বদলে বহাল রাখা হয়েছে নয়া আইনে। দেশদ্রোহ বলে কিছু অভিযোগকে চিহ্নিত করে সংশ্লিষ্ট ধারার সাজার মেয়াদও বাড়ানো হয়েছে।
নতুন আইনে মৃত্যুদণ্ড প্রয়োগের পরিধি বাড়ানো হয়েছে। ব্রিটিশ আমলে হত্যা-সহ একাধিক অপরাধে মৃত্যুদণ্ড সর্বদা এক নম্বরে থাকত। যাবজ্জীবন দু নম্বরে বিকল্প শাস্তি হিসাবে ছিল। মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে যদি কোনও বিচারক দণ্ডিতকে যাবজ্জীবন সাজা দিতেন, তা হলে কারণ উল্লেখ করতে হত কেন মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়নি। কিন্তু মৃত্যুদণ্ড দিলে কারণ উল্লেখ করতে হত না। স্বাধীনতার পর সুপ্রিম কোর্ট মৃত্যুদণ্ডের পরিধি ক্রমশ সঙ্কুচিত করে দিয়েছিল। নয়া আইনে নানা ধরনের অপরাধে মৃত্যুদণ্ডকে এক নম্বরে স্থান দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, মৃত্যুদণ্ড মকুব করার নানা সাংবিধানিক পদ্ধতিকে কাটছাঁট করার বিধান রয়েছে ন্যায় সংহিতা আইনে।
নয়া আইনে বদল আনা হয়েছে যাবজ্জীবন সাজার বিধানেও। ফৌজদারি দণ্ডবিধিকে ১৪ বছর কারাবাসের পরে মুক্তির আর্জি বিবেচনার সুযোগও আছে। নয়া ভারতীয় ন্যায় সংহিতায় বলা হয়েছে—যাবজ্জীবন মানে জীবনের বাকি পুরো সময়ের জন্যেই কারাবাস।
নাগরিক সুরক্ষা সংহিতায় মোট ১৫ দিনের পরেও আরও ৭৫দিন পুলিশ হেফাজতে অভিযুক্তকে জেরার জন্যে রাখার বিধান রাখা হয়েছে। আইনজ্ঞ এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলির বক্তব্য, এর ফলে পুলিশ হেফাজতে অত্যাচার, হত্যার ঘটনা আরও বেড়ে যেতে পারে। সব ধরনের বন্দিকে হাতকড়া পরিয়ে জনসমক্ষে নিয়ে যাওয়ার নয়া ধারা নতুন আইনে যুক্ত করা হয়েছে। যদিও সুপ্রিম কোর্ট এবং একাধিক হাই কোর্ট বহু মামলায় হাতকড়া পরানো নিয়ে আপত্তি তুলেছে। বর্তমানে বেআইনি পথে উপার্জিত অর্থ, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার অধিকার এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের আইনে রয়েছে। সেই অধিকার আগামী দিনে পুলিশও পেতে চলেছে। ভারতীয় নাগরিক সংহিতায় তার বিধান রেখেছে সরকার। এরফলে দাগী অপরাধীদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার পরিধি বৃদ্ধি পাবে সন্দেহ নেই, কিন্তু সাধারণ মানুষও হেনস্থার শিকার হতে পারেন, আশঙ্কা বিভিন্ন মহলের
নতুন সাক্ষ্য আইনে বলা হয়েছে, ন্যায় সংহিতার যে সমস্ত ধারায় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা, ফৌজদারি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ইত্যাদি ক্ষেত্রে অথবা উপদ্রুত আইন যেখানে বলবৎ আছে, সেই সমস্ত ধারায় অভিযুক্তদেরই প্রমাণ করতে হবে, তাঁরা দোষী নন, নির্দোষ। আইনজ্ঞ মহলের অভিমত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ, ভারত যা মেনে চলে, নয়া আইনের এই অংশ তার পরিপন্থী। মানবাধিকার সনদে বলা হয়েছে, যতক্ষণ না অপরাধ প্রমাণিত হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত অভিযুক্ত নির্দোষ। নয়া আইন এই মৌলিক ধারণার বিরোধী বলে নানা মহলের অভিমত।
বিরোধীদের বক্তব্য, তিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিধি বদলে যে ন্যূনতম মতামত সংগ্রহ, আলোচনার প্রয়োজন ছিল তা করা হয়নি। এর আগে একাধিক বার ফৌজদারি বিধিতে সামান্যতম পরিবর্তনেও সম্ভাব্য পরিবর্তনের খসড়া বিভিন্ন স্তরে আলোচনার জন্যে আগাম প্রকাশের নজির রয়েছে। সরাসরি বিল আকারে সংসদে পেশের দৃষ্টান্ত নেই।
অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, নয়া আইনে বিচার ব্যবস্থাতেও পরিবর্তন আসবে, এমনকী সমস্যাও সৃষ্টি হতে পারে। কারণ, এত বছর ধরে দণ্ডবিধি, ফৌজদারি কার্যবিধির ধারাগুলির পর্যালোচনায় বিভিন্ন আদালত যে-সব রায় দিয়েছে, কেস-ল তৈরি হয়েছে—সে-সবের কী হবে, প্রশ্ন তুলেছেন তারা। কারণ, ধারাগুলির শুধু সংখ্যার পরিবর্তনই হয়নি—অনেকগুলি ধারার বস্তুগত পরিবর্তন হয়েছে। ফলে বিচারে সঙ্কটের সমস্যার থেকেই যায়। এমনকী থানা-পুলিশের রোজকার কাজ আরও শ্লথ হয়ে পড়া, দীর্ঘসূত্রতা বাড়ারও আশঙ্কা করছেন অনেকে।
কোনও অপরাধীর সাজা কমানোর ক্ষেত্রে প্রচলিত ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৩৫ ধারায় বলা ছিল রাজ্য সরকারকে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। নয়া আইনে বিষয়টি আলোচনায় সীমাবদ্ধ নেই, কেন্দ্রীয় সরকারের সম্মতি বাধ্যতামূলক করতে চাওয়া হয়েছে। প্রচলিত ৪৩৩ ধারায় ফাঁসির সাজাপ্রাপ্তের সাজা কমিয়ে ১০ বছর কারাদণ্ড করারও সুযোগ ছিল। নয়া আইনে একমাত্র যাবজ্জীবন সাজা অবধিই কমানো যাবে।