শেষ আপডেট: 9th December 2024 15:11
দ্য ওয়াল ব্যুরো: পথ দেখিয়েছিল শ্রীলঙ্কা। একই পথের অনুগামী হয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং সশস্ত্র বিদ্রোহের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন হলেও দেশের মানুষের মনে 'স্বৈরাচারী' সরকার বিরোধী ক্ষোভের আগুনের বহিঃপ্রকাশটি কিন্তু এক। তাই জনবিদ্রোহের রোষে সরকার পতনের পর সব অগ্নিগ্রাস গিয়ে পড়ে রাজরাজড়ার মতো জীবনযাপন করা শাসকের ঘরবাড়ির উপর। শ্রীলঙ্কাতে যা দেখা গিয়েছিল, বাংলাদেশেও তা ঘটেছে। সম্প্রতি ঘটেছে সিরিয়ায়।
এর কারণ বছরের পর বছর ধরে মানুষের মনে জমে থাকা ক্ষোভের বিস্ফোরণ। দীর্ঘদিনের হতাশার বাষ্প ফেটে বেরনোতেই এই কাণ্ড ঘটে। এর সঙ্গে জুড়ে রয়েছে সেই দেশের যুগ যুগ ধরে চলতে থাকা আর্থিক বৈষম্যের দিকটি। শ্রীলঙ্কা হোক বা বাংলাদেশ, সিরিয়া- এই তিন দেশেই একটা সময় মধ্যবিত্ত শ্রেণি বিলুপ্তপ্রায় হয়ে গিয়েছিল। সমাজের আর্থিক কাঠামো বিভাজন হয়ে যায় ধনী এবং গরিবে। ধনী মানের টাকার পাহাড়ে বসে থাকা একটা শ্রেণি। এবং গরিব মানে প্রায় না খেতে পাওয়া সংখ্যাগরিষ্ঠের দল।
শ্রীলঙ্কা
২০২২ সালের জুলাই মাস। গোটা বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে শ্রীলঙ্কার আপামর জনতা রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপক্ষের প্রাসাদের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। শান্তিপূর্ণ সেই মিছিলে পুলিশ-মিলিটারি বাধা দিলেও বলপ্রয়োগ করল না। বিশাল ঋণভারে জর্জরিত শ্রীলঙ্কা সরকারের সে সময় চিন সহ বিভিন্ন দেশের কাছে গলা পর্যন্ত ডুবে ছিল। অথচ রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী সহ সরকারি কর্তাব্যক্তিদের বিলাসী জীবনের কোনও অভাব ছিল না।
সাধারণ মানুষ এটিএমে গিয়ে মুদ্রা পাচ্ছে না। পেট্রল পাম্পে তেল নেই। জ্বালানির দাম অগ্নিমূল্য বললেও কম বলা হবে। চতুর্দিকে দুধ, ওষুধসহ খাদ্যদ্রব্যের অভাব। নিত্যপ্রয়োজনীয়-অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বাজার থেকে উধাও। ফলে কয়েক দশক ধরে শাসনক্ষমতা ধরে রাজাপক্ষে এবং তাঁর পরিবারই হয়ে উঠল গণশত্রু। রাজধানী কলম্বোর রাস্তায় ক্ষোভে আছড়ে পড়ল লাখে লাখে মানুষ। কোনও দলবাজি নয়, জাতীয় পতাকা নিয়ে রাজধানীর দখল নিল জনতা।
সেই মিছিলই এগিয়ে শেষপর্যন্ত একের পর এক সরকারি বাসভবন ও কার্যালয় দখল করল। সে সময় রাজাপক্ষের প্রাসাদ দখল এবং সেখানে লুটপাটের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল। সাধারণ মানুষের প্রাসাদ দখল করার কারণ শুধু সরকার পতনের নজির নয়, মূলত দিনের পর দিন ধরে চলা হতাশা, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচার, অর্থকষ্টের প্রতিশোধ গ্রহণ। যেমনটা ঘটেছিল সে সময়ের শ্রীলঙ্কায়। বৈদেশিক ঋণের ভারে ডুবে থাকা সরকার তখন বেসামাল, নিজেকে রক্ষা করতে না পেরে দেশে ছেড়ে পালিয়ে যান রাজাপক্ষ।
বাংলাদেশ
বাংলাদেশে শুধু শেখ হাসিনার পতনই নয়, একাধিকবার সরকার পতন হয়েছে গণ-অভ্যুত্থানে অথবা সেনা অভ্যুত্থানে কিংবা রাষ্ট্রনেতার হত্যাকাণ্ডে। গত ৫ অগস্ট শেখ হাসিনার নাটকীয়ভাবে হেলিকপ্টারে চড়ে পালিয়ে যাওয়ার আগেও পাকিস্তানের হাত থেকে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশ বারবার রাজনৈতিক অস্থিরতার মুখোমুখি হয়েছে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এদেশের একাধিক নেতাকে হয় দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়েছে নয়তো খুন হতে হয়েছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন। তারপরেই ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে তিনি দেশে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা চালু করে রাষ্ট্রপতি হন। এর এক বছরের মধ্যে একদল সেনা তাঁর বাড়িতে ঢুকে মুজিব, তাঁর স্ত্রী ও তিন ছেলেকে গুলি করে হত্যা করে।
তখন সেনাবাহিনীর সমর্থনে খোন্দকার মোস্তাক আহমেদ ক্ষমতায় বসেন। কিন্তু, কিছুদিনের মধ্যে সেনাপ্রধান খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সেনা অভ্যুত্থান ঘটে ৩ নভেম্বর। তাঁকেও হত্যা করা হয়। এরপর বেশ কয়েকবার সেনা অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থানের পর ৭ নভেম্বর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতা গ্রহণ করেন। কিন্তু ৬ বছরের মধ্যে জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ১৯৮১ সালের ৩০ মে হত্যা করে সেনাদল।
জেনারেল হুসেইন মহম্মদ এরশাদের মদতে উপরাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তার ক্ষমতায় বসেন। কিন্তু পরের বছরের ২৪ মার্চ রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানে তাঁকেও সরিয়ে দেন এরশাদ। এবং দেশে সামরিক শাসন জারি করেন। দেশ জুড়ে গণতন্ত্রের দাবিতে কোণঠাসা এরশাদ ১৯৯০ সালের ৫ ডিসেম্বর পদত্যাগ করেন। ১২ ডিসেম্বর তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। দুর্নীতির অপরাধে তাঁর জেল হয়।
১৯৯১ সালে দেশে প্রথম অবাধ নির্বাচন হয়। সেই ভোটে জিয়াউর রহমানের বিধবা স্ত্রী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী পার্টি নেত্রী খালেদা জিয়া প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হন বাংলাদেশের। ১৯৯৬ সালে মুজিব-কন্যা হাসিনা তাঁকে হারিয়ে আওয়ামি লিগের প্রধানমন্ত্রী হন।
সিরিয়া
সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ কয়েকদিনের সমস্যা নয়। এর শুরু ২০১১ সালে। সেই থেকে আসাদ ও দেশে গেড়ে বসা তাঁর পরিবার, যা ছিল কেন্দ্রীয় ক্ষমতায়, তার বিরুদ্ধে মানুষের রাগ ফুটছিল। আসাদ এবং তাঁর পরিবারের সুখসম্পদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ, যাঁদের অধিকাংশই অত্যন্ত দরিদ্র তাঁদের মনে ক্ষোভের আগুন জমছিল। আর সে কারণেই দামাস্কাস দখলের পরে একের পর এক সরকারি ভবন ও প্রাসাদে ঢুকে পড়েন সাধারণ মানুষ। যাঁদের মধ্য সশস্ত্র বিদ্রোহীরা যেমন ছিল, তেমনই ছিলেন পুরুষ, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, শিশু-নারীরাও। তার কারণ রাষ্ট্রপ্রধানের ভবনই স্বেচ্ছাচারিতার মূল কেন্দ্রীয় বিন্দু। এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই জনরোষ আছড়ে পড়েছে সেই ভোগবিলাসের মূল আখড়ায়।
ইতিহাসেও প্রমাণ মেলে বিপ্লবের জয়ে ফ্রান্সের বাস্তিল দুর্গ, রাশিয়ার উইন্টার প্যালেস এবং চিনের সামার প্যালেসের দখল নিয়েছিল আমজনতা।