শেষ আপডেট: 26th January 2025 11:33
প্রজাতন্ত্র দিবস, গণতন্ত্র দিবস, সাধারণতন্ত্র দিবস—২৬ জানুয়ারিকে যে নামেই চিহ্নিত করা হোক না কেন, আসলে তা সংবিধান দিবস। সংবিধান সুরক্ষিত থাকলে বাকিগুলি প্রাসঙ্গিক। ১৯৫০-এ চালু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ১২৭ বার সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদের পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করা হয়েছে। বিশ্বে খুব কম দেশেই এমন নজির আছে।
আজ রবিবার আমরা যখন সংবিধান দিবস পালন করছি, তখন পড়শি বাংলাদেশে সংবিধান নিয়ে তুমুল কাটাছেঁড়া চলছে। সে দেশের সংবিধান সংশোধন কমিশন বিদ্যমান সংবিধানের চার মূল স্তম্ভ জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র থেকে প্রথম তিনটি ছেঁটে ফেলার সুপারিশ করেছে। সে দেশের স্বাধীনতা তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও লক্ষ্যকে সামনে ১৯৭২ সালের সংবিধানে এই চার স্তম্ভ যুক্ত হয়েছিল।
ভারতে সংবিধান চালুর সময়ে প্রস্তাবনায় বলা হয়েছিল, ভারত একটি সার্বভৌম-গণতান্ত্রিক-প্রজাতন্ত্র। ১৯৭৬ সালে তাতে যুক্ত হয় আরও দুটি শব্দ, ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ও ‘সমাজতান্ত্রিক’। দেশ তখন জরুরি অবস্থার কবলে। সেই অস্থির পরিস্থিতির মধ্যে সংবিধান সংশোধন করে ইন্দিরা গান্ধী আসলে নিজের রাজনৈতিক অবস্থাকে খানির পাকাপোক্ত করে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কারণ, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি গোড়ায় সংবিধানে প্রস্তাবনায় না থাকলেও বিভিন্ন অনুচ্ছেদের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট করা ছিল যে, ভারতের কোনও রাষ্ট্রধর্ম নেই। এখানে রাষ্ট্র কোনও ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করবে না। ফলে পক্ষপাতিত্বের প্রশ্নই ওঠে না। তবু সংবিধানের প্রস্তাবনায় ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটির অন্তর্ভুক্তি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের খানিক বাড়তি মনোবল জোগায় সন্দেহ নেই। অন্যদিকে, অখণ্ড ভারতের বাকি দুই অংশ পাকিস্তান ঘোষিতভাবে ইসলামিক রিপাবলিক এবং বাংলাদেশে শেখ মুজিবুরের সংবিধান সংশোধন করে পরবর্তীকালে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা হয়। যদিও ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটিও পরবর্তীকালে ফের যুক্ত হয়। সংবিধান সংশোধন কমিশন ফের সেই শব্দটি বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেছে। ছেঁটে ফেলার সুপারিশ করেছে ‘সমাজতান্ত্রিক’ শব্দটিও।
তাৎপর্যপূর্ণ হল, ভারতেও এই দুটি শব্দ নিয়ে আপত্তি, বিবাদ বিদ্যমান। বর্তমান শাসক গোষ্ঠীর ঘোর আপত্তি শব্দ দুটি নিয়ে। গত লোকসভা ভোটের ফলাফল বলছে, ভারতবাসীর তাতে সায় নেই। নরেন্দ্র মোদীর সরকার তৃতীয়বার চারশোর বেশি আসন জিতে ক্ষমতায় ফিরলে সংবিধান বদলে দেবে, বিরোধীদের এই প্রচার মানুষ যে বিশ্বাস করেছে, ফলাফলেই তা স্পষ্ট। তাই নরেন্দ্র মোদী ফের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পেলে দেশবাসী তাঁর সরকারের ডানা অনেকটাই ছেঁটে দিয়েছে।
আমাদের সংবিধানে ‘সমাজতান্ত্রিক’ শব্দটি মার্কসীয় সমাজতন্ত্রের ধারণা থেকে আলাদা। রাষ্ট্রীয় এবং ব্যক্তিমালিকানা, এ দেশের আর্থিক কাঠামোর মধ্যে দুইয়েরই প্রাধান্য আছে। তবু এই শব্দটির অন্তর্ভুক্তির মধ্য দিয়ে কল্যাণকামী রাষ্ট্রের ভাবনাটিকে আরও একটু স্পষ্ট করার চেষ্টা হয়েছিল। হতে পারে, জরুরি অবস্থা নিয়ে ঘরে-বাইরে সমালোচনার মুখে ইন্দিরা গান্ধী দেখাতে চেয়েছিলেন, দেশকে তিনি কেমন নতুন পথে চালিত করতে চাইছেন। যাই হোক, সব মিলিয়ে ভারত এখন সার্বভৌম-সমাজতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ-গণতান্ত্রিক-প্রজাতন্ত্র।
এগারো বছর আগে, নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতার আসার পরের বছর প্রজাতন্ত্র দিবসের একটি সরকারি বিজ্ঞাপনে দেখা যায়, ‘সমাজতান্ত্রিক’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দ দুটি নেই। সরকারি মহল থেকে বলা হয়, এটা নিছকই ক্রটি। কিন্তু কেন্দ্রের শাসকদল এবং সামগ্রিকভাবে গেরুয়া শিবির সংবিধানের সেই ত্রুটিপূর্ণ প্রস্তাবনাকেই স্বাগত জানাতে কুণ্ঠা করেনি। তারা বলতে চেয়েছিল, শব্দ দুটি বাদ দেওয়াই শ্রেয়।
১৯৭২ সালে কেশবানন্দ ভারতী মামলায় এক ঐতিহাসিক রায়ে সুপ্রিম কোর্ট বলে, সংবিধানের মূল কাঠামোকে কোনওভাবেই বদলানো যাবে না। ভারতের সংসদেরও সে ক্ষমতা নেই। সেই রায়ের উল্টোপথে হেঁটেই ইন্দিরা গান্ধী দুটি শব্দ যুক্ত করেছিলেন সংসদে সংবিধানের ৪২তম সংশোধনী এনে। যদিও তাতে সংবিধানের মূল কাঠামো এবং বার্তার কোনও পরিবর্তন করা হয়নি।
নরেন্দ্র মোদীর সরকার কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা (সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ) বিলোপ করেছে। অযোধ্যায় রাম মন্দিরের শিলান্যাস করেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। নাগরিকদের অনেকেরই প্রত্যাশা এবং একাংশের আশঙ্কা ছিল যে, স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষে লালকেল্লার ভাষণে প্রধানমন্ত্রী অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করার কথা ঘোষণা করতে পারেন। শেষ পর্যন্ত তিনি সে পথে হাঁটেননি। যদিও আজ সংবিধান দিবসেই দেশে প্রথম, বিজেপি শাসিত উত্তরাখণ্ডে চালু হচ্ছে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি। যার ফলে ওই রাজ্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ব্যক্তিগত আইন আর কার্যকর থাকবে না।
গেরুয়াবাদীদের হৃদয়ে থাকা ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাটির একটি নুমনা দেশবাসী টের পান ২০২০-র ৫ অগাস্ট। গোটা দেশ করোনা লকডাউনে ঘরবন্দি। এমন পরিস্থিতির মধ্যেও প্রধানমন্ত্রী সাড়ম্বরে অযোধ্যায় রামমন্দিরের শিলান্যাস করেছিলেন।
আমাদের সংবিধান প্রত্যেক নাগরিকের ধর্মাচরণের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করার কথা বলেছে। প্রশ্ন হল, রাম মন্দিরের শিলান্যাস করেছেন কে? ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, নাকি জনৈক নাগরিক নরেন্দ্র মোদী? করোনার কারণে যখন নানা ধর্মাবলম্বী মানুষের উৎসব, অনুষ্ঠান, সম্মিলীত উপাসনা, মেলামেশা রাষ্ট্রের নির্দেশে বন্ধ রাখা হয়েছিল, তখন রামমন্দিরের শিলান্যাস কোনও ধর্মনিরপেক্ষতার নজির গড়েছিল? শিলান্যাসের পর সাড়ম্ভরে মন্দিরের উদ্বোধনও করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
আসি ‘সমাজতান্ত্রিক’ শব্দটিতে। মোদী সরকার সংসদের একটি অধিবেশনের শেষ দিনে একপ্রকার বলপূর্বক বিমা বিল পাশ করিয়েছে। বিমা সংক্রান্ত যে সংশোধনীগুলি এ যাবৎ পাশ হয়েছে, তাতে জীবন এবং সাধারণ বিমার সরকারি সংস্থাগুলির বেসরকারিকরণ সময়ের অপেক্ষা মাত্র। ভারতীয় জীবন বিমা নিগম বা এলআইসি হল সেই প্রতিষ্ঠান যার সঙ্গে কোটি কোটি ভারতবাসীর জীবনের সুরক্ষা এবং এজেন্সি মারফৎ কয়েক লাখ মানুষের রুটিরুজির সম্পর্ক জড়িয়ে আছে। নরেন্দ্র মোদী চা বিক্রেতা না হয়ে এলআইসির এজেন্ট হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকত না।
শুধু জীবন বিমা কেন, ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা থেকেও রাষ্ট্র ক্রমশ হাত গুটিয়ে নিচ্ছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কও আজ নামেই সরকারি। তার বাণিজ্যিক কৌশলের মধ্যে রাষ্ট্রীয় কর্তব্য পালনের বিন্দুমাত্র ছাপ নেই। সরকারি ভাতা ইত্যাদির লেনদেনের সুবাদে এখন বহু পরিবারে ব্যাঙ্কের একাধিক অ্যাকাউন্ট। একজনের দু-তিনটি অ্যাকাউন্টও বিরল নয়। কিন্তু ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার এই প্রসারের মধ্য দিয়ে ব্যাঙ্কের বাণিজ্য বিস্তার লাভ করেছে সন্দেহ নেই। কিন্তু ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাঙ্ক চলছে তেলা মাথায় তেল দেওয়ার নীতিতে। বেশিদিন আগের কথা নয়, রিকশ, ভ্যান, ছোট-বড় বাণিজ্যিক গাড়ি, ছোট দোকান ইত্যাদিতে শোভা পেত ঋণ প্রদানকারী ব্যাঙ্কের নাম। সে সব এখন উধাও। ফলে পরিযায়ী অর্থনীতিই ভবিতব্য। করোনাকালে অর্থমন্ত্রী যে আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করলেন, তাও মূলত ব্যাঙ্ক ঋণ। আর কে না জানে, যার বন্ধক রাখার মতো সম্পদ আছে, তাকেই ব্যাঙ্ক সম্পদ বাড়াতে সাহায্য করে।
টেলি-যোগাযোগ ব্যবস্থাটির কী হাল, প্রতিদিন আমরা টের পাচ্ছি। বিএসএনএল-কে বলতে গেলে গলা টিপে মেরে ফেলা হল। মোবাইল, ইন্টারনেটের ব্যবসাটির পুরোটাই তুলে দেওয়া হচ্ছে বেসরকারি হাতে। তাদের নিত্যনতুন প্যাকেজের ঠেলায় জনগণ একদিকে ব্যতিব্যস্ত। ছাড়ের আশায় ছুটতে গিয়ে পকেট ফুটো হয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। আর যোগাযোগ ব্যবস্থা? প্রাইভেট ট্রেন তো এল বলে। রেলের বাজেট পেশের পর্বটি বছর কয়েক হল তুলে দেওয়া হয়েছে। তার দরকারও হয়তো আর ক’দিন পরে পড়বে না। কারণ, বেসরকারি কোম্পানির ভাড়া বৃদ্ধির সঙ্গে তো আর লোকসভা, রাজ্যসভার কোনও সম্পর্ক থাকবে না।
ফলে সংবিধানের প্রস্তাবনায় সমাজতান্ত্রিক শব্দটি আজকের ভারতবর্ষে কোনও তাৎপর্য বহন করে না। শব্দটিতে অর্থহীন করে দিয়েছিলেন তিন দশক আগের কংগ্রেস সরকারের অর্থমন্ত্রী সদ্য প্রয়াত মনমোহন সিং। কিন্তু ১৯৯১-এর সেই বাজেটে নতুন পথ অর্থাৎ নেহেরু, ইন্দিরার হাতে তৈরি রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির কাঁধে ভর দিয়ে চলা পথের উল্টো রাস্তায় হাঁটার যে নিদান তিনি দিয়েছিলেন, তাতে রাষ্ট্রের দায় সংকোচনের কথা বলার পাশাপাশি উচ্চকণ্ঠে দেশের দারিদ্র মুক্তির লক্ষ্যে উচ্চবিত্তের উপর বাড়তি করের বোঝা চাপানোর কথা বলা হয়েছিল। ইন্দিরা সংবিধানে ‘সমাজতান্ত্রিক’ শব্দটি জুড়েছিলেন এর দেড়-দু দশক আগে। উদ্দেশ্য ছিল, নাররিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টনের নিশ্চয়তা দান।
উদার অর্থনীতির সাড়ে তিন দশকের মাথায় এসে দেখা যাচ্ছে, উল্টো চিত্র। সম্পদের প্রবলতর কেন্দ্রীভবন হয়েছে গুটি কয়েক পরিবারের হাতে। ফলে বৈষম্যই যেন নবভারতের ভবিতব্য। সেই সত্যকে চেপে রেখে মনমোহনের তৈরি করে দিয়ে যাওয়া পিচে এখন চুটিয়ে রান তুলতে চাইছেন নরেন্দ্র মোদী। তাতে শিল্প-বাণিজ্যের পসার হলেও তা ক্রমবর্ধমান বেকারির সঙ্গে তাল মেলাতে ব্যর্থ।
সংবিধানের প্রস্তাবনায় একেবারে গোড়া থেকেই ভারতকে একটি সাধারণতন্ত্র বা রিপাবলিক বলা হয়েছে। সাধারণতন্ত্র বা প্রজাতন্ত্রের মূল ভাবনাটি হল, জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকার জনগণের স্বার্থে পরিচালিত হবে এবং মন্ত্রীমণ্ডলীসহ জনপ্রতিনিধিরা জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবেন। জবাবদিহির সবচেয়ে বড় মঞ্চটি হল সংসদ। মোদী সরকারের অভিধানে জবাবদিহি শব্দটি অনুপস্থিত।
ভারত একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, বিস্তৃত নাগরিক পরিসরে এই শব্দটির তাৎপর্য ও ব্যাপকতা সম্পর্কেও আমরা সকলেই কম-বেশি ওয়াকিবহাল। আজকের ভারতে দিন দিন গণতন্ত্রের ধারণাটিকে ক্রমশ সঙ্কুচিত করে নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকেই মূল প্রতিপাদ্য করে তোলা হয়েছে। বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে নির্বাচিত শাসক দলই শেষ কথা। সেই নয়া গণতান্ত্রিক পরিমণ্ডলে নাগরিকের কথা অর্থাৎ অভাব-অভিযোগ-সমালোচনা মনযোগ দিয়ে শোনার কর্তব্য রাষ্ট্র ক্রমশ অস্বীকার করছে তাই নয়, রাষ্ট্রই বলছে বেশি। জনগণতন্ত্রের অর্থ হয়ে দাঁড়িয়েছে, বলো কম, শোনো বেশি।
রইল বাকি সার্বভোম শব্দটি। এর অর্থ দেশের জনগণ এবং সংসদই ঠিক করবে দেশের ভূত-ভবিষ্যৎ। সেই মতো রচিত হবে আইন, বিধি। কিন্তু উদার অর্থনীতি পরবর্তী ভারতবর্ষের সংসদে যত আইন প্রণয়ন হয়েছে তার অনেকগুলির সঙ্গেই জড়িয়ে আছে ভিন দেশি বণিকের স্বার্থরক্ষার দায়। ফলে নাগরিক জীবনে সংবিধান যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে বিয়ের বেনারসী। বিয়ের পর পরই ট্রাঙ্ক বন্দি। বছরে এক-দু’বার পরা, তারপর পরম যত্নয়াত্তি করে আবার ট্রাঙ্কে তুলে রাখা। স্বাধীনতা দিবস তেমনই সংবিধান নাড়াচাড়া করার একটি দিন।