শেষ আপডেট: 4th January 2025 18:14
দ্য ওয়াল ব্যুরো: ছত্তীসগড়ে তরুণ সাংবাদিক মুকেশ চন্দ্রকর খুনে নাটকীয় মোড়। এই খুনে শনিবার বিকেলে পুলিশ সাংবাদিকের তুতো ভাই রীতেশ চন্দ্রকর সহ তিনজনকে টানা জিজ্ঞাসাবাদের পর গ্রেফতার করল। বস্তার জেলার মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকায় ১২০ কোটি টাকার সড়ক নির্মাণ প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে খবর করেছিলেন সাংবাদিক মুকেশ। তারপরেই গত ১ জানুয়ারি থেকে তিনি নিখোঁজ হন। গতকাল, শুক্রবার সন্ধ্যায় স্থানীয় এক সড়ক ঠিকাদার সুরেশ চন্দ্রকরের বাড়ির সেপটিক ট্যাঙ্ক থেকে উদ্ধার করা হয় মুকেশের মৃতদেহ। যদিও আরেক অভিযুক্ত ঠিকাদার সুরেশ এখনও পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
বস্তার এলাকার গঙ্গালুর থেকে হিরোলি পর্যন্ত একটি রাস্তা নির্মাণের জন্য টেন্ডার হয়েছিল ৫০ কোটি টাকার। কিন্তু, পরে সেই নির্মাণ খরচ ১২০ কোটি টাকায় পৌঁছে যায়, যার মধ্যে কাজের পরিবর্তন, সংযোজন, বৃদ্ধির কোনও উল্লেখ ছিল না। সেই অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশের পরই ওই ঠিকাদারের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকার তদন্তের নির্দেশ দেয়। যা নিয়ে ঠিকাদারের বাড়িতে গত ১ জানুয়ারি একটি আলোচনার ব্যবস্থা করে মুকেশের তুতো ভাই রীতেশ। দেহ উদ্ধারের পরেই রীতেশকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে পুলিশ। তারপর আর এক আত্মীয় দীনেশ চন্দ্রকর, রীতেশ চন্দ্রকর সহ মোট তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
এদিকে, এই খুনের তদন্তে রাজ্য সরকার একটি বিশেষ তদন্তকারী দল গঠন করেছে। মূল অভিযুক্ত ঠিকাদার সুরেশ চন্দ্রকরের তিনটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বাজেয়াপ্ত করেছে পুলিশ। সাংবাদিক খুনের ঘটনা নিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে বর্তমানে তোলপাড় চলছে। এডিটর্স গিল্ড এই খুনের তীব্র নিন্দা করে মুকেশের পরিবারের প্রতি শোকপ্রকাশ করেছে। রায়পুর প্রেস ক্লাবের তরফেও এদিন একটি বিক্ষোভ-প্রতিবাদসভার আয়োজন করা হয়। তাঁর সহকর্মী সাংবাদিক বন্ধুরা শহরের ৩৬ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখান। ঠিকাদারের মৃত্যুদণ্ডের দাবি তোলা হয়েছে। সাংবাদিকরা অবিলম্বে বিজাপুর জেলার পুলিশ সুপারকে বদলির দাবি জানিয়েছেন।
এই খুনের সঙ্গেই জড়িয়ে পড়েছে রাজনীতিও। বিজেপির অভিযোগ, অভিযুক্ত ওই ঠিকাদারের সঙ্গে কংগ্রেসের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। অন্যদিকে, কংগ্রেস এই ঘটনাকে বিজেপির জঙ্গলরাজ বলে ব্যাখ্যা করে। কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়ঙ্কা গান্ধী বঢরা এক এক্সবার্তায় এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি তুলেছেন। ইতিমধ্যেই রাজ্যের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী বিষ্ণুদেও সাই পুলিশকে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বুলডোজার নীতি গ্রহণের নির্দেশ দেন। সেইমতো শনিবারেই পুলিশ অভিযুক্তের একটি আস্তানা বুলডোজার দিয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়।
এদিকে, জানা গিয়েছে ঠিকাদার সুরেশ চন্দ্রকর বিপুল ধনসম্পত্তির মালিক ও রাজনৈতিক উপর মহলে তার নিয়মিত ওঠাবসা রয়েছে। বিয়ের সময় স্ত্রীর আবদার রাখতে সে যা করেছিল, তা নিয়ে সেই সময় বিরাট চর্চা হয়েছিল রাজ্যে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে রেণুকা নামে এক মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হয় সুরেশের। বিজাপুরের আয়োজিত ওই বিয়েতে বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি এসেছিলেন। সুরেশ হবু স্ত্রীকে কথা দিয়েছিল, এমন বিয়ে হবে যা দেখে তাক লেগে যাবে সকলের এবং রেণুকার চিরদিন মনে থাকবে। শোনা যায়, রেণুকা-সুরেশের বিয়েতে আনুমানিক ১০ কোটি টাকার মতো খরচ হয়েছিল। রেণুকার বিদায়লগ্নকে স্মৃতিতে ধরে রাখতে আস্ত একটি হেলিকপ্টার ভাড়া করে আনে সুরেশ।
ছত্তীসগড়ের বিজাপুর জেলায় খুন হওয়া সাংবাদিক মুকেশ চন্দ্রকর একসময় বস্তারে মাওবাদীদের হাতে অপহৃত সিআরপিএফ জওয়ানের মুক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। ২০২১ সালে কয়েকজন জওয়ানকে অপহরণ করেছিল মাওবাদীরা। তারমধ্যে এক কোবরা কমান্ডো রাকেশ্বর সিং মানহাসের মুক্তির বিষয়ে তিনি মধ্যস্থতা করেন। বস্তার এলাকার মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকায় ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতা করতেন মুকেশ। নকশাল হামলা, সংঘর্ষ সহ বিভিন্ন ধরনের খবর করতেন অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে। একটি জাতীয় চ্যানেলের স্টিনজার হিসেবেও কাজ করতেন। এছাড়া, বস্তার জংশন নামে তাঁর নিজস্ব একটি ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে। যা সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা ১.৫৯ লক্ষ। মুকেশের মৃত্যু নিয়ে ইতিমধ্যেই রাজ্যের শাসকদল বিজেপি এবং বিরোধী দল কংগ্রেসের মধ্যে চাপানউতোর শুরু হয়ে গিয়েছে।
উল্লেখ্য, সড়ক প্রকল্পে দুর্নীতির খবর ফাঁসের কয়েকদিন পরেই ২৯ বছর বয়সি এই সাংবাদিকের মৃতদেহ উদ্ধার হয়। ১ জানুয়ারি থেকে নিখোঁজ ছিলেন মুকেশ চন্দ্রকর নামে ওই সাংবাদিক। তাঁর দাদা যুকেশ চন্দ্রকর পুলিশে নিখোঁজ ডায়েরি করেছিলেন। নিখোঁজ হওয়ার পর থেকেই মুকেশের ফোন সুইচড অফ ছিল। পুলিশ শুক্রবার একটি সেপটিক ট্যাঙ্কের ভিতর থেকে ওই সাংবাদিকের দেহ উদ্ধার করে। ঠিকাদারের বাড়ির পিছনে থাকা সেপটিক ট্যাঙ্কের মুখ সিমেন্ট দিয়ে বাঁধাই করে দেওয়ায় পুলিশের মনে সন্দেহ দানা বাঁধে।
গত ১ জানুয়ারি রাত থেকে মুকেশের আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। ওইদিনই ঠিকাদার সুরেশ চন্দ্রকরের ভাই রীতেশের সঙ্গে মুকেশের একটি আলোচনার কথা ছিল। সুরেশেরই একটি আস্তানায় তাঁদের দেখা হয়েছিল। আর তারপর থেকেই সাংবাদিকের ফোন সুইচড অফ হয়। নিখোঁজের খবর পেয়েই পুলিশ তৎপর হয়ে তদন্তে নামে। সব সম্ভাব্য জায়গায় মুকেশের খোঁজে নেমে পড়ে বিশেষভাবে গঠিত একটি টিম।
শুক্রবার সন্ধ্যায় চাট্টনপাড়া এলাকায় ঠিকাদার সুরেশের বাড়ির সেপটিক ট্যাঙ্ক থেকে তরুণ সাংবাদিকের দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এখানেই তাঁকে শেষবারের জন্য দেখা গিয়েছিল। এক পদস্থ পুলিশ অফিসার বলেন, সিসিটিভি ফুটেজ ও মোবাইলের শেষ লোকেশন ট্রাক করে আমরা ঠিকাদারের বাড়িতে তল্লাশি চালাই। সেখানেই ট্যাঙ্কের ভিতর থেকে দেহ উদ্ধার হয়। পুলিশ আরও জানিয়েছে, ঠিকাদার পালিয়ে গেলেও তাঁর ভাইকে হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। আরও কয়েকজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।