শেষ আপডেট: 12 December 2023 12:43
ফল ঘোষণা হয়েছিল ৩ ডিসেম্বর। নয় দিনের মাথায় রাজস্থানের পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রীর নাম ঘোষণা করল বিজেপি। রবি ও সোমবার ঘোষণা করা হয় যথাক্রমে ছত্তিসগড় ও মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীদের নাম।
মুখ্যমন্ত্রী বাছাইয়ে অতীতে বিজেপিতে এমন বিলম্বের নজির নেই। দীর্ঘসূত্রিতা নিয়ে তাই বিজেপিকে খোঁচা দিতে ছাড়েনি কংগ্রেস।
তবে শেষ পর্যন্ত গেরুয়া শিবির তিন রাজ্যে যে নেতাদের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে বেছে নিল তাতে মতবিরোধ, মুখ্যমন্ত্রী বাছাইয়ে বিলম্ব নিয়ে আলোচনা উবে গিয়ে সেই জায়গা দখল করেছে তিন নেতা বাছাইয়ের নয়া কৌশল।
ছত্তিসগড়, মধ্যপ্রদেশ এবং রাজস্থানে হেলায় জিতলেও বিজেপি যে বিস্তর পরীক্ষানিরীক্ষা করে নতুন মুখ্যমন্ত্রী বাছবে তা বোঝাই যাচ্ছিল। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহরা যেভাবে শিবরাজ সিং চৌহান, রমন সিং এবং বসুন্ধরা রাজের বিকল্প হিসাবে আলোচিত নেতাদের বাদ দিয়ে আনকোরা নেতাদের মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে বসিয়ে দিলেন, সাম্প্রতিক অতীতে এমন চমকের নজির নেই।
তবে মোদী-শাহ জুটি শুধু নতুন মুখ আনেননি, হিন্দি বলয়ের তিন রাজ্যের বাস্তবতা বিবেচনায় রেখে জাতপাতের রাজনীতির নিখুঁত সমীকরণ অনুসরণ করেছেন বিরোধীদের নয়া কাস্ট রণনীতির মোকাবিলায়।
ছত্তিসগড়ে বিজেপির জয়ে এবার বড় ভূমিকা নিয়েছে আদাবাসিরা। বিরোধীরা বারে বারেই বিজেপিকে আদিবাসী বিরোধী দল হিসেবে তুলে ধরে। সেই প্রচার মোকাবিলা করে আদিবাসী বহুল ওই রাজ্যে জনজাতিদের সিংহভাগ ভোট পদ্মের ঝুলিতে গিয়েছে। এবার মুখ্যমন্ত্রী বাছার সময় আদিবাসী ভোট ধরে রাখার বিষয়টিকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদীররা।
জাতের সামাজিক সমীকরণ বা সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কথা মাথায় রেখেই মধ্যপ্রদেশে গেরুয়া শিবির মুখ্যমন্ত্রী বদল করতে গিয়ে ওবিসি অঙ্কে বিশেষ জোর দিয়েছে। বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান নিজেও ওবিসি সম্প্রদায়ের মানুষ। তাঁর জায়গায় ওই সম্প্রদায়েরই নতুন মুখ এনে ওবিসি ভোটের উপর পদ্ম শিবির নিজেদের প্রভাব আরও বাড়িতে নিতে চাইল।
মধ্যপ্রদেশে মোহন যাদবকে বেছে নেওয়ার পিছনে এক ঢিলে অনেক পাখি মেরেছেন মোদী-শাহ জুটি। মুখ্যমন্ত্রী হতে মুখিয়ে ছিলেন কৈলাশ বিজয়বর্গীয়, প্রহ্লাদ যোশী, নরেন্দ্র সিং তোমর এবং জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ারা। কৈলাশ, তোমররাও ওবিসি নেতা। বিজেপি সূত্রের খবর শিবরাজের উত্তরসূরি হিসেবে এই নেতাদের বসালে দলে গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব মাথাচাড়া দিত। তাই লো প্রোফাইল নেতাকে মুখ্যমন্ত্রী করে রাজ্যের রশি নিজেদের হাতে রাখলেন মোদী-শাহ।
অন্যদিকে, ব্রাহ্মণ ভজনলাল শর্মাকে মুখ্যমন্ত্রী করে বৃহত্তর হিন্দু ঐক্য রক্ষার রাস্তায় হেঁটেছেন প্রধানমন্ত্রী। রাজস্থানে ব্রাহ্মণ মুখ হিসাবে আলোচনায় ছিলেন রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণ। দৌড়ে ছিলেন কেন্দ্রের জলশক্তি মন্ত্রী গজেন্দ্র সিং শেখাওয়াত, আইনমন্ত্রী অর্জুন রাম মেঘওয়ালও। এছাড়া স্বঘোষিত দাবিদার দু বারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজে সন্ধিয়া তো ছিলেনই। কিন্তু জাতের সামাজিক অঙ্কে কেউ পাশ মার্ক পাননি মোদী-শাহের।
মোদীর এই অঙ্ক বা কৌশল একেবারে নতুন বলা যাবে না। এর আগে মহারাষ্ট্রে দেবেন্দ্র ফড়ণবিশ, ঝাড়খণ্ডে রঘুবর দাস, উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথ, অসমে হিমন্ত বিশ্ব শর্মা, গুজরাতে ভূপেন্দ্র প্যাটেলকে মুখ্যমন্ত্রী করেছে মোদী শাহ জুটি অনেক পরিচিত ও অভিজ্ঞ মুখকে বাস দিয়ে।
কিন্তু এই দফায় হিন্দি বলয়ের তিন রাজ্যে তাঁরা নতুন মুখ আনার পাশাপাশি জাতের সমীকরণকে বাড়তি গুরুত্ব দিয়েছেন। রাজনীতিতে এই পরীক্ষা নিরীক্ষা মায়াবতী মডেল হিসাবে পরিচিত। ২০০৭ -এ উত্তরপ্রদেশে এই দলিত নেত্রী দলের মাথায় বসান ব্রাহ্মণ সতীশ শর্মাকে। ২৫ শতাংশ আসনে প্রার্থী করেন উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণদের। তার আগে রাজ্যে ব্রাহ্মণ, দলিত, কায়স্থ সম্মেলন করে জাতের ঐক্য গড়ার রাস্তায় হেঁটে সফল হন। ২০০৭ এর উত্তরপ্রদেশের বিধানসভার ভোটে জাতের সামাজিক সমীকরণ বা কাস্ট ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অঙ্কে বিজেপি ও সমাজবাদী পার্টিকে ধরাশায়ী করে বহুজন সমাজ পার্টি।
একইভাবে মোদী-শাহ কংগ্রেস-সহ বিরোধীদের কাস্ট সেন্সাস ও সংরক্ষণ বৃদ্ধির রণকৌশলের মোকাবিলায় মায়াবতী মডেলকে হাতিয়ার করলেন হিন্দি বলয়ের তিন রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী বাছাইয়ে, যেখানে জাতপাতের সমীকরণে বদলে যায় ভোটের হিসাবনিকাশ।