শেষ আপডেট: 27th September 2024 14:48
দ্য ওয়াল ব্যুরো: মেজাজটাই তো আসল রাজা...রক্তে রয়েছে যে প্রাচীন নবাবি কেতা। রাজত্ব গেলেও রাজরক্ত যায় কী করে? তাই কৌলীন্য বজায় রাখতে এখনও স্পষ্ট কথা বলতে 'জবান' আড়ষ্ট হয়ে যায় না। 'টাইগারের' ছেলে তো টাইগারই হবে, না কী! সে কারণেই এককালের মরচে ধরা সেই তলোয়ারে ফের ঝলসে উঠল আগুন। কী ধরনের রাজনীতিককে আপনি পছন্দ করেন? একটুখানি ভাবার সময় নিয়ে জবাব এল, আমি সাহসী ও সৎ রাজনীতিক পছন্দ করি।
সঙ্গে সঙ্গে বেছে নেওয়ার জন্য তিনটি প্রশ্ন উড়ে এল, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, দিল্লির প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল নাকি বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী? কাকে বেশি সৎ এবং সাহসী মনে হয়? জবাব, আমার মনে হয় এই তিনজনই সৎ এবং সাহসী। তবে রাহুল গান্ধী অভাবনীয় কাজ করেছেন। মোদী এবং বিজেপির একচ্ছত্র আধিপত্যের দিনেও অকপটভাবে রাহুলের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন 'টাইগার' মনসুর আলি খান পতৌদির ছেলে সইফ আলি খান। কারণ, অন্যায়-অপশাসন, প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার পাশাপাশি সইফের ধমনীতেও বইছে কংগ্রেস-অনুরক্তির পরম্পরা। কারণ, সইফের বাবা জগদ্বিখ্যাত ক্রিকেটার পতৌদিও ছিলেন প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। সেই কাহিনি জানতে পিছু হাঁটতে হবে কয়েক যুগ।
ক্ষমতার সিংহাসনে অপ্রতিরোধ্য ইন্দিরা গান্ধী একসময় ব্রিটিশ শাসনাধীনকালের নবাবি, রাজত্ব ও জমিদারি প্রথা বিলোপ করে দেন। স্বাধীনতার সময় এক চুক্তিতে ঠিক হয়েছিল দেশীয় রাজন্য ও নবাবি বংশধরদের খাইখরচ চালাবে সরকার এবং তাঁদের সম্পদ ও জমিজমা সার্বভৌম ভারতের হয়ে যাবে। ১৯৭১ সালে সংবিধানের ২৬-তম সংশোধনীতে ইন্দিরা গান্ধী তা তুলে দিলে প্রতিবাদ করেন মনসুর আলি খান পতৌদি।
পতৌদির নবাব পরিবারের তরুণ রক্ত বেছে নিলেন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রতিবাদের ভাষা। বিশ্বাসভঙ্গের বিরুদ্ধে লোকসভা ভোটে জনমত এককাট্টা করার জন্য দাঁড়ালেন। নিক্তি মেপে পরখ করতে চাইলেন প্রজাদের রাজভক্তি বেশি নাকি রাজনীতির প্রভাব বেশি। তখন হরিয়ানার অংশ পতৌদি নবাবি রাজ্য। ইন্দিরার সেই বিতর্কিত বিলের প্রতিবাদ উঠল কংগ্রেসের অভ্যন্তরেও। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মোরারজি দেশাই পর্যন্ত বললেন, এই কানুন কংগ্রেসের চুক্তির বিশ্বাসভঙ্গ করবে। কিন্তু ইন্দিরা ছিলেন একরোখা।
সে কারণে ভারতের সুপুরুষ দেবকান্তি ক্রিকেটার গুরুগ্রাম থেকে ভোটে দাঁড়ালেন। গড়ে উঠল বিশাল হরিয়ানা পার্টি। সেই ভোটে পতৌদি ৫ শতাংশের কম জনমত পেয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৭১ সালের পরাজয়েই নেহরু-গান্ধী পরিবারের সঙ্গে পতৌদি পরিবারের গাঁটছড়া ছিন্ন হল না। ১৯৯১ সালে রাজীব গান্ধী যখন ক্ষমতায় ফেরার লড়াইয়ে নামলেন, তখন টাইগার ফের রাজনীতির রং ধারণ করলেন।
পতৌদির পরবর্তী রাজনৈতিক ক্রিজ হল ভোপাল। রাজীব গান্ধীর সমর্থনে মায়ের বাপেরবাড়ি থেকে প্রার্থী হলেন। পতৌদির মা বেগম সাজিদা সুলতান ছিলেন ভোপালের নবাব-কন্যা। তিনিই ছিলেন ভোপালের শেষ নবাবি বংশধর। রাজীব গান্ধী নিশ্চিন্ত ছিলেন ভোপাল জয়ে। কারণ এই পরিবার ছিল সবথেকে জনপ্রিয়। মায়ের মৃত্যুর পর পতৌদিই হয়েছিলেন মুত্তাওয়ালি অর্থাৎ ওয়ারিশ। তা সত্ত্বেও ১৯৯১-এর ভোট পতৌদির পক্ষে সুখকর হয়নি। তিনি অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বুঝে গিয়েছিলেন এখানে ভোট ব্যাঙ্ক হিন্দু-মুসলমানে বিভক্ত।
রাজীব গান্ধী স্বয়ং প্রচারে এসেও কংগ্রেসের অভ্যন্তরের কোন্দলে সেই ভোটেও হেরে যান পতৌদি। সেই প্রচারে পতৌদির সঙ্গে স্ত্রী শর্মিলা ঠাকুরও। বিশাল ভিড়ে ঠেসে গিয়েছিল জনসভা। তখনও অনেকের চোখে অমলিন ছিল পতৌদির সেই ফটো ফিনিশ কভার ড্রাইভ এবং ভুবনভোলানো হাসির রেশ। এই প্রচারের পরেই শ্রীপেরুমবুদুরে তামিল জঙ্গিদের হাতে নিহত হন রাজীব। সেই সহানুভূতির ভোটে সব প্রার্থী উড়ে গেলেও হেরে যান পতৌদি। কংগ্রেসেরই সাবাতাজে হারেন নবাব। ১৯৭১-এর গুরুগ্রামের মতোই ১৯৯১-এ অর্জুন সিং, শুক্লা ভ্রাতৃদ্বয় এবং সিন্ধিয়াদের যোগসাজশে হারেন তিনি।
সুতরাং, বলা যায় নেহরু-গান্ধী পরিবারের সঙ্গে পতৌদি পরিবারের সম্পর্ক একরকমের নবাবি রক্ত ও রাজনীতিক রক্তের এক ফল্গুধারা। সমান্তরালভাবে যা প্রবহমান হয়ে রাহুল গান্ধী ও সইফ আলি খানের জমানাতেও বয়ে চলেছে। সে কারণেই ইন্ডিয়া টুডে-র কনক্লেভে সইফ নির্দ্বিধায় বলতে পারেন, একসময় রাহুলের কথায় কেউ পাত্তা দিতেন না, ওনার সব কাজকে সমালোচনা করত মানুষ, হাসাহাসি করত। কিন্তু তিনি কাজ দিয়ে নিজেকে আমূল বদলে ফেলেছেন।
দেশের কিংবদন্তি ক্রিকেটার পতৌদির নবাবজাদা সইফের এই স্বীকারোক্তি ইতিমধ্যে ভাইরাল হয়ে গিয়েছে। রাজনৈতিক থ্রিলার তাণ্ডবে একটি সইফ এক প্রধানমন্ত্রীর উত্তরসূরির চরিত্রে অভিনয় করেছেন। অনেকেই এই চরিত্রকে রাহুল গান্ধীর সঙ্গে সদৃশ বলে তুলনাও টেনেছেন। এখন খানসাহেবের মুখে রাহুলের প্রতি পূর্ণ সমর্থনের দাবার চাল সইফ আলি রাজনীতির কোন শতরঞ্জ কি খিলাড়ির দিকে টেনে নিয়ে যায়, সেটা সময়ই বলবে।