শেষ আপডেট: 8th December 2023 19:21
দ্য ওয়াল ব্যুরো: প্রশ্ন-ঘুষ কাণ্ডে মহুয়া মৈত্রর বিরুদ্ধে এথিক্স কমিটির সুপারিশের সিলমোহর পড়ল লোকসভায়। শুক্রবার ধ্বনি-ভোটের মাধ্যমে স্থির হয় মহুয়ার ভাগ্য। সাংসদ পদ খারিজ হয়ে গেল তৃণমূল নেত্রীর।
এই ঘটনার সূত্রপাত সেই অক্টোবর মাসে। মহুয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল লোকসভায় প্রশ্ন করার জন্য তিনি নাকি শিল্পপতি দর্শন হীরানন্দানির কাছ থেকে ঘুষ বাবদ নগদ ও নানা ধরনের উপহার নিয়েছেন। বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে এই ব্যাপারে প্রথম সরব হন। তারপর এই বিষয় নিয়ে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ চলে সমান তালে। অবশেষে শুক্রবার মহুয়ার সাংসদ পদ খারিজ হল লোকসভায়।
এক নজরে দেখে নেওয়া যাক কীভাবে এগোল মহুয়া বিতর্ক---
গত ১৪ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জয় অনন্ত দেহাদরাই সিবিআই ও লোকসভার স্পিকারকে চিঠি পাঠান। সেখানেই মহুয়ার বিরুদ্ধে টাকার বিনিময়ে সংসদে প্রশ্ন করা অভিযোগ করেন জয়। তবে মহুয়া প্রথম থেকেই এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন। মহুয়ার দাবি ছিল, তাঁর বিরুদ্ধে কুৎসা প্রচার করা হচ্ছে। এমনকী এই ষড়যন্ত্রে যুক্ত আছেন তাঁর 'প্রাক্তন বয়ফ্রেন্ড'ও! উল্লেখ্য বিষয়, একসময় মহুয়ার বয়ফ্রেন্ড ছিলেন জয়ই।
মহুয়ার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ নিয়ে সরব হন বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে। তিনি লোকসভার স্পিকারকে চিঠি লিখে মহুয়াকে সাসপেন্ড করার আবেদন জানান। তিনি টেনে আনেন ব্যবসায়ী দর্শন হীরানন্দানিকে। তাঁর অভিযোগ, সংসদে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে প্রশ্ন ও গৌতম আদানির সমালোচনা করার জন্য মহুয়া টাকা ও দামি উপহার নিয়েছিলেন দর্শনের থেকে।
নিশিকান্তের মতে, মহুয়ার এই পদক্ষেপ সংসদীয় বিশেষাধিকার লঙ্ঘন করে। এমনকী সংসদের অবমাননা করেছেন মহুয়া। এই অভিযোগের পরই মহুয়া আইনি নোটিস পাঠান নিশিকান্তকে। এছাড়াও বারবার হেনস্থা করার জন্য জয়ের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ জানিয়েছিলেন মহুয়া।
নিশিকান্তের অভিযোগের পরই নড়েচড়ে বসে লোকসভার এথিক্স কমিটি। বিজেপি সাংসদের দাবির সত্যতা নিয়ে তদন্ত শুরু করে তারা। মহুয়ার বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ ছিল, তিনি নাকি নিজের লোকসভা সাইটের লগইন আইডি ও পাসওয়ার্ড দর্শনকে দিয়েছিলেন।
মহুয়ার বিরুদ্ধে শিল্পপতি দর্শন হীরানন্দানি একটি হলফনামা দাখিল করেন। তিনি দাবি করেন, মহুয়া তাঁকে ব্যবসায়িক সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার নামে তাঁর কাছ থেকে অন্যায্য সুযোগ নিয়েছিলেন। মহুয়ার আবদার ও বায়নাক্কা মেটাতে গিয়ে তাঁকে দামি উপহার, বিদেশে ছুটি কাটানোর খরচ, দিল্লির বাংলো মেরামত করে অনেক কিছু করেছেন।
মহুয়ার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত করে এথিক্স কমিটি। কমিটির চেয়ারম্যান বিনোদ সোনকার জানিয়েছিলেন, ঘটনার বিস্তারিত তদন্তের জন্য সমস্ত দিক যাতে খতিয়ে দেখা যায়, সেইজন্য তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্র এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে চিঠি দেওয়া হয়। সবকিছু খতিয়ে দেখে কমিটি গত ৩১ অক্টোবর তদন্তের স্বার্থে মহুয়াকে তলব করে।
তবে মহুয়া জানান, ৩১ অক্টোবর তিনি হাজিরা দিতে পারবেন না। ৫ নভেম্বরের পরেই এথিক্স কমিটির সামনে হাজির হতে পারবেন। কিন্তু মহুয়ার আবেদনের পাত্তা দেয়নি এথিক্স কমিটি। ২ নভেম্বর মহুয়াকে হাজির দিতেই হবে জানিয়ে দেয় তারা।
গত ২ নভেম্বর এথিক্স কমিটির সামনে হাজিরা দেন মহুয়া। যদিও সেই বৈঠকের মাঝপথেই মহুয়াকে বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। তাঁর অভিযোগ ছিল, কমিটি তাঁকে 'নোংরা' প্রশ্ন করেছে। যা খুবই অপমানজনক। পাল্টা কমিটিও মহুয়ার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। তদন্ত শেষে তারা মহুয়ার সাংসদ পদ খারিজের সুপারিশ করে।
মহুয়া কাণ্ডে প্রথমে ডেরেক ও'ব্রায়েনদের দাবি ছিল, সংসদীয় প্যানেলের তদন্ত শেষ হলে তৃণমূল যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। তবে পরে খোদ তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে দাঁড়ান। মমতাকে এও বলতে শোনা যায়, 'এদের প্ল্যান এখন মহুয়াকেও তাড়িয়ে দেওয়া। এতে মহুয়ার লাভ। মহুয়া আরও জনপ্রিয় হয়ে যাবে। যে কথাগুলো মহুয়া এতদিন সংসদের ভেতরে বলছিল, এখন সেগুলো বাইরে বলতে পারবে। মূর্খ না হলে কেউ এমন করে?' এমনকী মহুয়াকে সাম্প্রতি কৃষ্ণনগর সাংগঠনিক জেলার সভানেত্রী করা হয়েছে। মহুয়ার বিরুদ্ধে বিজেপি আওয়াজ তুললেও প্রথম থেকে প্রশ্ন ঘুষ কাণ্ডে তাঁর পাশে আছেন কংগ্রেস-সিপিএমের মতো বিরোধী দলগুলিও।
এথিক্স কমিটি তদন্ত শেষ করে একটি রিপোর্ট তৈরি করে। সেই রিপোর্টে মহুয়ার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের সত্যতাকেই মান্যতা দেওয়া হয়। এমনকী তাঁর সাংসদ পদ খারিজের সুপারিশ করা হয়। ঠিক হয়, শীতকালীন অধিবেশনেই মহুয়ার বিরুদ্ধে প্রশ্ন-ঘুষ কাণ্ডের রিপোর্ট পেশ করবে এথিক্স কমিটি।
তারমধ্যেই শোনা যায়, লোকপালের নির্দেশেই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী এজেন্সি সিবিআই মহুয়ার বিরুদ্ধে প্রাথমিক তদন্ত শুরু করেছে। তবে এই মামলায় মহুয়াকে গ্রেফতার করতে পারবে না সিবিআই। প্রাথমিক তদন্ত শেষে রিপোর্ট লোকপালের কাছে জমা দেবে তারা।
গত ৩ ডিসেম্বর থেকে সংসদে শুরু হয় শীতকালীন অধিবেশন। মনে করা হয়েছিল প্রথম দিনেই মহুয়ার বিরুদ্ধে রিপোর্ট পেশ করবে এথিক্স কমিটি। তবে তা করা হয়নি। অবশেষে শুক্রবার সেই সন্ধিক্ষণ উপস্থিত হয়। মহুয়ার বিরুদ্ধে এথিক্স কমিটি রিপোর্ট পেশ করে। তৃণমূল, কংগ্রেস সহ বিরোধী দলগুলির দাবি ছিল, রিপোর্ট পড়ার জন্য সময় দেওয়া হোক। সেইসঙ্গে মহুয়াকে নিজের বক্তব্য রাখার সুযোগ দিক স্পিকার।
বিরোধীদের এই অভিযোগ নাকচ করে দেন ওম বিড়লা। তিনি বলেন, মহুয়া এথিক্স কমিটির কাছে নিজের বক্তব্য রাখার সুযোগ পেয়েছিলেন। তারপরই আধঘণ্টা এই বিষয়ে আলোচনার পর ধ্বনি ভোট নেওয়া হয়। সেই ভোটেই মহুয়ার সাংসদ পদ খারিজের আবেদন পাশ হয়ে যায়।
সংসদ ভবন থেকে বেরিয়ে এসে মহুয়া বলেন, “আমাকে কোনও কথা বলার সুযোগ দিয়ে এক তরফা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।” মহুয়ার দাবি, তাঁকে বহিষ্কার করার ব্যাপারে এথিক্স কমিটির সুপারিশ করার কোনও অধিকার নেই। মহুয়ার পাশে দাঁড়িয়েছেন মমতাও। তিনি কার্শিয়াংয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে বলেন, পুরোটাই রাজনৈতিক প্রতিহিংসা নিয়ে করা হল। মহুয়ার সঙ্গে সুবিচার করা হল না। আমি একবার ভেবেছিলাম প্রধানমন্ত্রী বোধহয় ব্যাপারটা বিবেচনা করবেন। কিন্তু দেখলাম গণতন্ত্রের কোনও স্থানই নেই।'