ভারতের দ্বিতীয় দলিত ব্যক্তি হিসেবে দেশের সর্বোচ্চ বিচারক- এই মর্মে ভারতের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে থাকবে তাঁর নাম।
১৪ মে, বুধবার, ভারতের ৫২তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে রাষ্ট্রপতি ভবনে শপথ শপথ নিলেন বিচারপতি ভূষণ রামকৃষ্ণ গাভাই
শেষ আপডেট: 15 May 2025 11:59
দ্য ওয়াল ব্যুরো: একসময় স্থানীয় পৌরসভার এক মারাঠি মাধ্যমের স্কুলে বেঞ্চ না থাকায় মাটিতে বসেই পড়তে হতো তাঁকে। সেখান থেকে দেশের শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতির আসন- এই উত্তরণ সহজ হয়তো ছিল না, নেপথ্যে ছিল কঠিন অধ্যাবসায়।
ভারতের ৫২তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নিলেন বিচারপতি ভূষণ রামকৃষ্ণ গাভাই। ১৪ মে, বুধবার, রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর হাতে রাষ্ট্রপতি ভবনে শপথ নেন তিনি। ভারতের দ্বিতীয় দলিত ব্যক্তি হিসেবে দেশের সর্বোচ্চ বিচারক- এই মর্মে ভারতের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে থাকবে তাঁর নাম। এর আগে ২০০৭ সালে বিচারপতি কে.জি. বালাকৃষ্ণন প্রথম দলিত সিজেআই হয়েছিলেন।
বিচারপতি সঞ্জীব খান্নার স্থানে নিযুক্ত হলেন তিনি। বিচারপতি গাভাই এই পদে থাকবেন আগামী ২৩ নভেম্বর, ২০২৫ পর্যন্ত।
এই সোনার ইতিহাস গড়ার শুরুটা সহজ ছিল না মোটেই। ৬৫ বছর আগে, ১৯৬০ সালের ২৪ নভেম্বর মহারাষ্ট্রের অমরাবতীর ফ্রেজারপুরা এলাকার বস্তিতে জন্ম বিচারপতি গাভাইয়ের। মা কমলতাই গাভাই ছিলেন স্কুলশিক্ষিকা এবং বাবা রামকৃষ্ণ সূর্যভান গাভাই ছিলেন আম্বেদকরপন্থী রাজনৈতিক দল রিপাবলিকান পার্টি অফ ইন্ডিয়া (গাভাই) শাখার প্রতিষ্ঠাতাদের একজন সদস্য।
ছোটবেলা থেকেই ভূষণের মনে গেঁথে গিয়েছিল সমাজসেবার মূল্যবোধ। তিন সন্তানের মধ্যে বড় ছিলেন ভূষণ। বাড়িতে নিত্যদিন অতিথিদের আনাগোনা লেগেই থাকত। তাঁদের জন্য ভাকরি (মারাঠি রুটি) বানানো, রান্নাবান্না করা, বাসন মাজা, খেতের সেচকাজ, এমনকী টিউবওয়েল বা চাপাকল থেকে জল তুলে এনে মায়ের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে সংসারে মিশে থাকতেন ছোট্ট ভূষণ।
বাড়ির বড় সন্তান বলেই হয়তো ছেলেবেলা থেকেই ভীষণ বুঝদার বাচ্চা ভূষণ। ছেলেবেলা যে ভীষণ সচ্ছলতায় কেটেছে এমন নয়, তবে ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁদের বাড়িতে নিয়মিত পাত পড়ত সৈনিকদের। ভীষণ কঠিন সেই সময় নিজের চোখে দেখেছেন, উপলব্ধি করেছেন তিনি। মায়ের সঙ্গে মিলে তাঁদের জন্য খাবার বানানো এবং পরিবেশন করতেন ভূষণ।
বস্তিতে থাকলেও তার পরিবেশের ছাপ কোনদিনও নিজের ওপর পড়তে দেননি বিচারপতি গাভাই, সেই ছোট বয়স থেকেই। মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা, ভাল ব্যবহার ছিল তাঁর চরিত্রের অন্যতম এক দিক।
বাবার মতোই বিআর আম্বেদকরের নীতি এবং আদর্শে প্রবলভাবে বিশ্বাসী বিচারপতি ভূষণ। ২০২৪ সালের এপ্রিলে এক ভাষণে তিনি বলেন, ‘যদি ডঃ আম্বেদকর না থাকতেন তাহলে আমার মতো একজন যে বস্তিতে বড় হয়েছে, সে এখানে এই জায়গায় আসতে পারত না।’
পড়াশোনা ও কর্মজীবন:
বি.কম শেষ করার পর ভূষণ যথারীতি আইন পড়তে যান অমরাবতী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২৫ বছর বয়সে, ১৯৮৫ সাল থেকে বোম্বে হাইকোর্টের নাগপুর বেঞ্চে সরকারি আইনজীবী ও অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবেও কাজ করেন। দুই দশকের যাত্রাপথে নাগপুর, ঔরঙ্গাবাদ, পানাজি, বোম্বে বেঞ্চের হয়ে কাজ করেছেন তিনি।
২০০৩ সালে তিনি বোম্বে হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত হন এবং ২০০৫ সালে স্থায়ী বিচারপতি হন। ২০১৯ সালের ২৪ মে তিনি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হন। নিজেই এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যদি দলিত না হতাম, তাহলে এই নিয়োগ হয়তো আরও দুই বছর পরে হতো।’
বিচারপতি গাভাই নিজের রায়ে মানবিকতার নিদর্শন রেখে চলছেন বরাবর। এমনও হয়েছে, দীর্ঘ দুই দশক পর নিজের বাড়ির মালিকানা ফিরে পেয়েছেন এক মহিলা, নেপথ্যে বিচারপতি গাভাই। জটিল কিছু মামলা যেমন, ইউএপিএ (UAPA) এবং সরকারি অর্থ তছরুপ বা প্রিভেনশন অফ মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট (PMLA) সংক্রান্ত মামলায় রায়দান করেছেন তিনি।
তিনি সেই বেঞ্চের সদস্য ছিলেন, যাঁরা সংবাদমাধ্যম নিউজক্লিক (Newsclick)-এর প্রতিষ্ঠাতা প্রবীর পুরকায়স্থ ও দিল্লির প্রাক্তন উপমুখ্যমন্ত্রী মনীষ সিসোদিয়াকে স্বস্তি দিয়েছিলেন। তাঁর নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ ঘোষণা দেয়, নাগরিকের সম্পত্তি ভেঙে ফেলার আগে যথাযথ প্রক্রিয়া না মানলে তা আইন লঙ্ঘনই বোঝায়।
তিনি ৭ বিচারপতির বেঞ্চে ছিলেন, যাঁরা সংরক্ষণের মধ্যে সাব-ক্লাসিফিকেশন বৈধ ঘোষণা করেন। তাঁর কথায়, ‘দলিতদের কোটা ভাগ করার বিরোধিতা করা একরকম সেই বৈষম্যেরই প্রতিচ্ছবি, যা উচ্চবর্ণরা করত।’
তিনি ছিলেন সংবিধান বেঞ্চে, যাঁরা ৩৭০ ধারা রদ বৈধ ঘোষণা করেন এবং ইলেক্টোরাল বন্ড বাতিল করেন। ২০২৫ সালে মণিপুর পরিদর্শনেও যান বিচারপতি গাভাই।
#WATCH | Delhi: CJI BR Gavai greets President Droupadi Murmu, Prime Minister Narendra Modi, Vice President Jagdeep Dhankhar, former President Ram Nath Kovind and other dignitaries at the Rashtrapati Bhavan. He took oath as the 52nd Chief Justice of India.
(Video Source:… pic.twitter.com/yMUL0Sw3LH— ANI (@ANI) May 14, 2025
বিচারপতি ভূষণের জীবনের চড়াই উতরাই পেরিয়ে আজকের এই সাফল্যের গাথা শুধু গাভাই পরিবারের নয়, সমগ্র মহারাষ্ট্রের জন্য এক গর্বের কারণ। ভারত এমন এক দেশ যেখানে রাষ্ট্রপতি হোক বা বিচারপতি- সাম্য শুধু সংবিধানের পাতায় নয়, বাস্তবেও প্রতিফলিত হয়েছে বারবার। কঠিন শৈশব, সামাজিক বাধা বা আর্থিক দুর্দশা পেরিয়ে নিষ্ঠা, শিক্ষা এবং ন্যায়বোধ দিয়ে লেখা হয়েছে দেশের ছেলের এই সোনার ইতিহাস।