শেষ আপডেট: 11th January 2025 13:08
দ্য ওয়াল ব্যুরো: ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে বর্তমানে বিস্মৃত হলেও ১১ জানুয়ারি অতি গুরুত্বপূর্ণ দিন। ১৯৬৬ সালের এই দিনেই সাবেক সোভিয়েত রাশিয়ার উজবেকিস্তানের তাসখন্দে রহস্যজনকভাবে মৃত্যু হয়েছিল ভারতের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর। যে রহস্যের অন্ধকার আজও কাটেনি। লোকমুখে গুঞ্জন যে, বিষপ্রয়োগ করে মারা হয়েছিল শাস্ত্রীকে। তাঁর মৃত্যুর রহস্য উন্মোচনে কয়েক বছর আগে তাসখন্দ ফাইলস নামে একটি চলচ্চিত্রও বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিল।
লালবাহাদুর শাস্ত্রীর জন্ম উত্তরপ্রদেশের মুঘলসরাইয়ে, ১৯০৪ সালের ২ অক্টোবর। আসল নাম ছিল লালবাহাদুর শ্রীবাস্তব। কাশী বিদ্যাপীঠ থেকে তিনি শাস্ত্রী উপাধি লাভ করেন। তাঁর জন্মদিনেই গোটা দেশ মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিন পালন করতে মেতে থাকায়, বেশিরভাগ মানুষই তাঁর জন্মদিনটি হারিয়ে ফেলেছেন মন থেকে। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাক যুদ্ধের সময় এলাহাবাদে তিনিই স্লোগান তুলেছেন, জয় জওয়ান, জয় কিষাণ। স্বাধীনতার আগে স্বামী বিবেকানন্দ ও গান্ধীর আদর্শে তিনি আন্দোলনে ঝাঁপ দেন। স্বাধীনতার পরে কংগ্রেস ও প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু মন্ত্রিসভায় গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। ১৯৬৪ সালে নেহরুর মৃত্যুতে তিনি দেশের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসেন।
১৯৪৭ সালে দেশের পুলিশ ও পরিবহণমন্ত্রী থাকাকালীন তিনি প্রথম মহিলা কন্ডাক্টর নিয়োগের বিষয়ে পদক্ষেপ করেন। জনতা বিক্ষোভ হটাতে লাঠিচার্জের জায়গায় জলকামান চালানোর নির্দেশ দেন। জীবদ্দশায় দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী ৫,০০০ টাকা গাড়িঋণ নিয়ে একটি ফিয়াট গাড়ি কিনেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর বিধবা পত্নী ফ্যামিলি পেনশন থেকে সেই টাকা শোধ দিয়েছিলেন। তাসখন্দে ভারত-পাক যুদ্ধের আবহে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মহম্মদ আয়ুব খানের সঙ্গে একটি ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যু হয় শাস্ত্রীর।
শোনা যায়, চুক্তি স্বাক্ষর নিয়ে খুশি ছিল না সোভিয়েতের চর সংস্থা কেজিবি। কারণ সেই সময়ে আমেরিকা-সোভিয়েতের ঠান্ডাযুদ্ধ চলাকালীন কেজিবি এবং সিআইএ-র মধ্যে স্নায়ুর লড়াই চলছিল। চুক্তি স্বাক্ষরের পর তিনি যে বাংলোয় ছিলেন সেখানে ফিরে খাওয়াদাওয়া করে শুয়ে পড়েন। কিন্তু, রাশিয়ায় জানুয়ারির প্রবল ঠান্ডায় খাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়েন প্রধানমন্ত্রী। অভিযোগ, তিনি অসুস্থ জেনেও তাঁর ঘরে আপৎকালীন কোনও ব্যবস্থা ছিল না। প্রধানমন্ত্রীর ডাক্তার আরএন চুঘ আসার আগেই শাস্ত্রীর মৃত্যু হয়। তবে সাধারণ মানুষের মনে বিশ্বাস, কেজিবির চররা তাঁকে খাবারে বিষ দিয়ে মেরে দিয়েছিল। শাস্ত্রীর মৃত্যুরহস্য আজও অতলে থাকার কারণ তথ্য জানার অধিকার আইনে সেই ফাইল প্রকাশ করতে অস্বীকার করে কেন্দ্রীয় সরকার। জানানো হয় তা গোপন তথ্য, যা দেশবাসীর সামনে প্রকাশ করার নয়।
দেশের এক বিরাট দুঃসময় ও সঙ্কটজনক মুহূর্তে মাত্র দেড় বছরের জন্য প্রধানমন্ত্রী পদে ছিলেন লালবাহাদুর শাস্ত্রী। কিন্তু, এই কম সময়ের ভিতরেই তিনি যা করেছিলেন, তা দেশ গঠনের প্রথম পর্বে মনে রাখার মতো কাজ। দেশের সামনে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধ, প্রবল খাদ্যসঙ্কটের মধ্যে হাল ধরেছিলেন টলমল করা নৌকার। খাবার বাঁচাতে তিনিই প্রথম যিনি দেশবাসীকে একদিন উপোস করে থাকার ডাক দিয়েছিলেন। যাতে আরও বেশিদিন ধরে মানুষ দুমুঠো খেতে পায়। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে দেশবাসী তাই করেছিল।
১৯৬৫ সাল। জম্মু-কাশ্মীরের পরিস্থিতি দিনদিন বিগড়ে যাচ্ছিল। এরকমই একদিন দেশের সেনাপ্রধান মধ্যরাতে প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে এলেন। সেনাপ্রধান তাঁকে বোঝান যে, যেভাবে পাকিস্তানি বাহিনী কাশ্মীর দখল করতে এগোচ্ছে, সেখানে ভারতীয় সেনাকেও লাহোর সীমান্ত পেরিয়ে ঢোকা উচিত বলে তিনি মনে করেন। লালবাহাদুর না ভেবে জবাব দিয়েছিলেন, অনুপ্রবেশকারীরা যখন কাশ্মীরে ঢুকেছে তখন আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে। তখন আমরাই বা কেন চুপ করে থাকব। আপনিও লাহোর দখলে এগিয়ে যান। আমি জানি, যা বলছি তার মানে কী, আর জানি বলেই বলছি।
এরপরেই ভারতীয় সেনাবাহিনী কাশ্মীরের জায়গায় লাহোর সীমান্ত দিয়ে অগ্রবর্তী হতে শুরু করে। পাক পাঞ্জাবের এবং লাহোর লাগোয়া অধিকাংশ এলাকা ভারতের কবজায় চলে আসে। অন্যদিকে, কাশ্মীর থেকেও লাগাতার অভিযানে শুরু হয় অনুপ্রবেশকারী জঙ্গিদের সরানোর কাজ। কিন্তু, মাঝপথে বাগড়া দেয় রাষ্ট্রসঙ্ঘ। পাকিস্তানের তদ্বিরে ১৯৬৫ সালের ২০ সেপ্টেম্বরে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব পাশ হয়।