ফাইল ছবি
শেষ আপডেট: 10 May 2025 22:17
দ্য ওয়াল ব্যুরো: গত ৭ মে বুধবার ভোর রাতে পহেলগাম হত্যাকাণ্ডের (Pahalgam Attack) জবাব দিয়েছিল ভারত। পাকিস্তানের সীমান্তের মধ্যে না ঢুকে নিঁখুত নিশানায় গুঁড়িয়ে দিয়েছিল পাকিস্তান ও পাক অধিকৃত কাশ্মীরের ৯টি জঙ্গি ঘাঁটি। তার পর থেকে হামলা ও পাল্টা হামলা এবং সীমান্তে রক্তক্ষয়ের পর শেষমেশ যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছে ভারত ও পাকিস্তান (India Pakistan Ceasefire)। নয়াদিল্লির দাবি, পাকিস্তানই প্রথমে ফোন করে যুদ্ধবিরতি চায়। ভারত তাতে সম্মত হয়।
এখন প্রশ্ন হল, এই যুদ্ধবিরতি কি ভারতের বড় রকমের সামরিক ও কূটনৈতিক জয়?
নয়াদিল্লির কূটনীতিকদের একটা অংশের মতে, অবশ্যই এটা নয়াদিল্লির বড় কূটনৈতিক জয়। বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও বিদেশ সচিব বিক্রম মিশ্রি প্রথম দিন থেকেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, ভারত উত্তেজনা বাড়াতে চায় না। পাকিস্তান ও পাক অধিকৃত কাশ্মীরের যে সব জঙ্গি ঘাঁটি থেকে ভারত বিরোধী সন্ত্রাসে মদত দেওয়া চলছে, তা ভারতীয় সেনাবাহিনী গুঁড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানের কোনও সামরিক ঘাঁটিতে আঘাত হানেনি। কারণ, নয়াদিল্লির তা উদ্দেশ্যও ছিল না।
কূটনীতিকদের মতে গোড়া থেকে ধারাবাহিক ভাবে এই বার্তা দিয়ে আন্তর্জাতিক মহলকে পাশে পেয়েছিল ভারত এবং সন্ত্রাসবাদের প্রশ্নে পাকিস্তানকে এক ঘরে করে ফেলেছিল। সেই বৃহৎ আন্তর্জাতিক কূটনীতির চাপেই পাকিস্তান যুদ্ধবিরতির শর্তে রাজি হতে বাধ্য হয়েছে। নয়াদিল্লির এই কূটনীতিকদের মতে, ভারতের লক্ষ্য কখনও বড় সামরিক অভিযান ছিল না। নয়াদিল্লির লক্ষ্য ছিল জঙ্গি ঘাঁটি ভেঙে দেওয়া, সেদিক থেকেও সফল ভারত।
তবে এটাই শেষ কথা নয়। কূটনীতিক ও ঘরোয়া রাজনীতিকদের আর একটি অংশ মনে করছে, এই যুদ্ধবিরতি ভারতের বড় কূটনৈতিক সাফল্য হতে পারত। কিন্তু নিজের সমাজমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প (Donald Trump on Ceasefire) আগবাড়িয়ে যে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে দিয়েছেন, তাতেই নয়াদিল্লির কৃতিত্বের ব্যাপারটা কিছুটা লঘু হয়েছে। ট্রুথ সোশ্যালে ট্রাম্প এদিন বলেন, “ভারত ও পাকিস্তান একটি পূর্ণাঙ্গ ও তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। আমেরিকার মধ্যস্থতায় দীর্ঘ রাতের আলোচনার পর এই সিদ্ধান্তে পৌঁছনো গেছে। দুই দেশকেই অভিনন্দন— তারা শুভবুদ্ধি ও গভীর বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন।”
ট্রাম্পের এই ঘোষণার কিছুক্ষণ পরই ভারতের বিদেশ মন্ত্রক সাংবাদিক সম্মেলন করে জানিয়ে দেয় — শনিবার বিকেল ৫টা থেকে ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে সম্মত হয়েছে। তবে আমেরিকার মধ্যস্ততা করার বিষয়টি নিয়ে নয়াদিল্লি কিছু বলেনি। ট্রাম্পের দাবি খন্ডনও করেনি। শুধু বিদেশ সচিব বিক্রম মিশ্রি জানিয়েছেন, যুদ্ধবিরতি চেয়ে পাকিস্তানই প্রথমে ফোন করেছিল। তার পর দু’দেশের মধ্যে সামরিক স্তরে আলোচনা হয়েছে।
ভারতীয় কূটনীতিক ও রাজনীতিকদের এই অংশের মতে, ট্রাম্প টুইট করে বুঝিয়ে দিয়েছেন তাঁরাই বিগ ব্রাদার। তিনি এই টুইট কিছুটা হলেও অস্বস্তি বাড়িয়েছেন।
ভারত-পাক সংঘর্ষ পরিস্থিতির মধ্যে আমেরিকা যে ক্রমশ মধ্যস্ততাকারীর ভূমিকা নিচ্ছে, তা গত কয়েকদিনে ক্রমশ স্পষ্ট হয়। মার্কিন বিদেশ সচিব মার্কো রুবি গত বৃহস্পতিবার ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। সেদিনই তিনি কথা বলেন পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সঙ্গে। নয়াদিল্লি সেদিনও জানিয়েছিল, ভারত উত্তেজনা বাড়াতে চায় না। বল ইসলামাবাদের কোর্টে। কিন্তু তার পরেও সেদিন ইসলামাবাদকে নমনীয় করতে পারেননি রুবিও। হয়তো গোটা ব্যাপারটা শুধু পাক প্রধানমন্ত্রীর হাতে ছিল না।
এর পর দেখা যায় শুক্রবার মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্স স্পষ্ট করে বলেন, ভারত-পাক সংঘাত তাদের নিজেদের ব্যাপার। আমাদের এ নিয়ে কোনও মাথাব্যাথা নেই।
আমেরিকা এভাবে হাত গুটিয়ে নেওয়ার কথা বলে হয়তো ইসলামাবাদের উপর আরও চাপ তৈরি করতে চায়। শেষমেশ দেখা যায়, শনিবার ভোরে পাক সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে ফোন করেন মার্কিন বিদেশ সচিব মার্কো রুবিও। এতে স্পষ্ট হয়ে যায়, শাহবাজের ক্ষমতা নেই। আসল ক্ষমতা রয়েছে জেনারেল মুনিরের।
কূটনৈতিক একটি সূত্রের দাবি, আমেরিকা স্পষ্ট করে দেয় যে পাকিস্তান যুদ্ধ বন্ধ না করলে আইএমএফ তথা আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার থেকে ১ বিলিয়ন ডলার ঋণ আটকে দেওয়া হবে। তাতেই নরম হতে বাধ্য হয় ইসলামাবাদ। চুম্বকে যুদ্ধবিরতির নেপথ্যে প্রতি পদে পদে আমেরিকার ফুট প্রিন্ট স্পষ্ট বলে অনেকের মত। বরং এও হতে পারে, ভারত ও নয়াদিল্লি দুজনেই চাইছিল যে আমেরিকা মধ্যস্ততা করুক। নইলে এই যুদ্ধের শেষ দেখা যাচ্ছিল না।
তবে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করলেও ঘরোয়া রাজনীতিতে একটা বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। দেশের সরকার যে সন্ত্রাসবাদের প্রশ্নে নরম নয় তা বোঝাতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় একটি নীতি এদিন পাশ করিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, এখন থেকে যে কোনও জঙ্গি কার্যকলাপকেই যুদ্ধ বলে মনে করা হবে।
সার্বিক এই প্রেক্ষাপটে লোকসভায় প্রাক্তন কংগ্রেস দলনেতা অধীর চৌধুরী এদিন বলেন,“ভারতের মানুষ কি এটাই চেয়েছিল? দেশের মানুষের প্রত্যাশাপূরণে সরকার কতটা সফল হল তা এখনও পরিষ্কার নয়। বরং এখনও কিছু প্রশ্নের উত্তর সরকার দিতে পারেনি। তা হল, পহেলগামে হামলা হল কেন? সেই গোয়েন্দা ব্যর্থতার দায় কার? এবং দুই, পহেলগামের আততায়ী বা জঙ্গিদের এখনও কেন গ্রেফতার করা গেল না”।
অধীর চৌধুরীর কথায়, “পহেলগাম কাণ্ডের পর সরকার দেখাতে চেয়েছিল পাকিস্তানে আঘাত হানার ব্যাপারে সরকার কোনও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে চায় না। সামরিক বাহিনীকেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আসলে সেটা অনেকটাই লোক দেখানো ছিল। কারণ, যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত কখনওই এদেশে সামরিক বাহিনী নেয়নি। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই হয়েছে বরাবর। আমার প্রশ্ন হল, সামরিক বাহিনীকে যদি যুদ্ধের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়, তাহলে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে তা থামানো হল কেন? সরকারকে এই কথাটাও বোঝাতে হবে দেশের মানুষকে”।