চকোলেট ডে
শেষ আপডেট: 9 February 2025 10:40
দ্য ওয়াল ব্যুরো: বসন্তের খামখেয়ালি বাতাসটা সবে বইতে শুরু করেছে। কন্দর্পের তির এলোপাথাড়ি বাঁক খেয়ে যার তার বুকে গিয়ে বিঁধছে। গোলাপ দেওয়া-নেওয়ার পালা চুকেছে পরশু। গতকাল ছিল হৃদয়ের ব্যাকুল কথাটি মাথা চুলকে বলে ফেলার দিন। আজ জবাবে ‘হ্যাঁ’-শোনা দোঁহে মিলে চকোলেটের মোড়ক খুলে ‘একবার তুমি-একবার আমি’ বলে প্রেম বিনিময়ের পালা সারবে। নইলে সমাজের মেনে নেওয়া-না মেনে নেওয়া সংক্রান্ত সমস্যাটি আরও গুরুতর চেহারা নিতে পারে!
তবে সমাজ যাই বলুক না কেন, বাজার বলছে, চকোলেট বিপণনে দেশজুড়ে আপাতত বইতে শুরু করেছে মলয় পবন। কয়েক বছর আগেও কোকো চাষে বিশ্ব মানচিত্রে ভারত সবহারাদের মাঝে ঠাঁই পেত। রমরমা ছিল আফ্রিকার। একচেটিয়া আধিপত্য দেখাত ঘানা, আইভরি কোস্ট সহ একাধিক দেশ। এখন পরিস্থিতি বদলেছে। চকোলেট রফতানি ও তার উৎপাদনেও সমীহ আদায় করে নিয়েছে ভারত। স্রেফ দক্ষিণী রাজ্যগুলি নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কোকো চাষের বাড়বাড়ন্ত লক্ষ করা যাচ্ছে।
সমীক্ষা বলছে, কোকো চাষিদের কাছে ফেব্রুয়ারিই প্রকৃত বসন্ত। কেরলের কোট্টায়ামের দেড় হাজার কৃষক চারাগাছ রোপণ করে বসন্তের সুর বেঁধে দেন। এরপর বাকি রাজ্যগুলি তাঁদের অনুসরণ করে। আজ বলে নয়, দীর্ঘ ছয় দশক ধরে এভাবেই কফির প্রধান উপকরণটি ভারত উৎপাদিত হয়ে আসছে। অথচ পরিস্থিতি পাল্টেছে হাল আমলে। পরিশ্রমের স্বীকৃতি জুটেছে অনেক দেরিতে। বিশ্বের শীর্ষ কুড়িটি কোকো উৎপাদক দেশের মধ্যে ঠাঁই করে নিতে পেরেছে ভারত। এক ইন্দোনেশিয়া ছাড়া এশিয়ার আর কোনও রাষ্ট্র এই তালিকায় জায়গা পায়নি।
এই সাফল্য যে শুধুমাত্র মেহনতের ফল—বিষয়টা তেমন নয়। কোকো চাষে অবিসংবাদিত নাম আফ্রিকা। বিশেষত পশ্চিম আফ্রিকা। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে কোকো চারার মূলে ভাইরাসের আক্রমণ, খামখেয়ালি আবহাওয়া, কীটনাশক, চাষিদের কোকো বেচে ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার অভিযোগ ঘানা, নাইজেরিয়ার মতো দেশগুলিকে ক্রমশ পেছনের সারিতে নিয়ে যায়। এখন অবস্থা এমনই যে, অনুমান করা হচ্ছে, ২০৫০ সালের মধ্যে আইভরি কোস্টের কোকো সর্বাধিক কোকো উৎপাদক দেশের চাষজমি অর্ধেক হ্রাস পেতে পারে। একইভাবে ফলন কমবে ঘানাতেও। ভাইরাসের হানায় প্রায় ৬ লক্ষ হেক্টর জমি নষ্ট হবে, আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
আর এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েছে ভারত। ফরচুন ইন্ডিয়া ও ক্যাসুনাট অ্যান্ড কোকো ডেভলাপমেন্ট (ডিসিসিডি)-র যৌথ সমীক্ষা থেকে জানা গিয়েছে, গত পাঁচ বছরে ভারতে কোকো উৎপাদন দ্রুতগতিতে বেড়েছে। ২০১৯-২০ সালে ২৫ হাজার ৭৮৩ মেট্রিক টন থেকে ২০২৩-২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪০ হাজার মেট্রিক টন। হেক্টর পিছু ফলন যেখানে ছিল ৬৬৯ কেজি, তা হালফিলে ৮২৫ কেজি ছুঁয়েছে। উৎপাদনবৃদ্ধি বাড়িয়েছে জমির পরিমাণও। শেষ হিসেবে দেশের ১ লক্ষ ১০ হাজার হেক্টর জমিতে কোকো চাষ হচ্ছে।
খুশির পালে হাওয়া জুগিয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কোকো চাষের সংস্কৃতি ছড়িয়ে যাওয়া। আগে দক্ষিণ ভারতেই যা সীমাবদ্ধ ছিল, ইদানীং সময়ে তা বিস্তৃত হয়েছে উত্তর-পূর্ব ভারতের একাধিক রাজ্যে। অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড, অসমের চাষিরা কোকো চাষে হাত পাকানো শুরু করেছেন। বিষয়টা আর তেলেঙ্গানা কিংবা গোয়া বেল্টে আটকে নেই। বাজার বাড়ছে। চাহিদা বাড়ছে। তাই পরীক্ষানিরীক্ষাও শুরু হয়েছে পুরোদমে। এমনিতে কোকো চাষ যথেষ্ট ঝক্কির এবং বিবিধ শর্তের অধীন। যার একটি হচ্ছে জলবায়ু। অন্যটি পারিপার্শ্বিক পরিবেশ। খোলা জমিতে এর আবাদ অসম্ভব। ফলে গবেষণায় জোর দেওয়া আশু প্রয়োজন। যাতে প্রতিবন্ধকতা এড়িয়ে ফলনের বৃদ্ধি ধরে রাখা যায়।
ইতিহাস বলছে, আটের দশক থেকে বিদেশি সংস্থাগুলি দেশীয় চাষিদের কোকো চাষে উৎসাহ দেওয়া শুরু করেছিল। কিন্তু বীজের গুণমান খারাপ হওয়ার কারণে অচিরেই হাল ছেড়ে দেয় তারা। বাধ্য হয়ে চাষিরা কোকোর বদলে রবার উৎপাদনে উৎসাহী হয়ে ওঠে। নয়েক দশকে এই বাজারেও ধাক্কা আসে। রবারের দাম কমে যায়, উলটে কোকোর মূল্যবৃদ্ধি হয়। এক দশক আগে প্রতি কেজি ১২০ টাকায় বিকোনো কোকো বীজ আপাতত ৫০০ টাকায় এসেছে ঠেকেছে।
আর এই কারণেই আফ্রিকাকে টেক্কা দিচ্ছে ভারত। দাবি ‘মনম চকোলেট’ সংস্থার কর্ণধার চৈতন্য মুপ্পালার। তাঁর যুক্তি: আফ্রিকার জিডিপি কোকোর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট। কিন্তু ভারতে তা ‘অর্থকরী ফসল’। ফলে আফ্রিকার দেশগুলির সরকার ইচ্ছেমতো মূল্য নির্ধারণ করে। কিন্তু এদেশে চাষিরা সরাসরি বাজারে বেচার সুযোগ পান। সাতসকাল উঠে বাজার যান তাঁরা এবং দামের হালহকিকত বিচার করেন। ফলে মূল্য নিয়ে কৃষকদের মধ্যে অসন্তোষ নেই বললেই চলে।
এই আবহে পশ্চিম গোদাবরীর পাহাড়ি তট থেকে কোকো উৎপাদনকে দেশব্যাপী করতে এগিয়ে এসেছে সেন্ট্রাল প্ল্যান্টেশন ক্রপস রিসার্চ ইন্সটিটিউট (সিপিসিআরআই) কিংবা কেরল অগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটির মতো প্রতিষ্ঠান। নিছক পূর্বনির্দিষ্ট জলবায়ুর উপর নির্ভরতা ছেড়ে যে কোনও পরিবেশে যাতে কোকো চাষ সম্ভব হয়, তার জন্য গবেষণা শুরু করেছে তারা।
ফলে কৃষক-বান্ধব বাজার, প্রযুক্তিগত সহায়তা, পিএইচ, আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণে বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে কাজে লাগানো—বিশ্বের কফি মানচিত্রে ভারতকে কুলীন আসনে বসিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সরকারের উচিত চাষিরা যাতে মার না খায়, উৎসাহ না হারায় সেটা সুনিশ্চিত করা। পাশাপাশি ‘প্রিমিয়াম’ মানের কোকোবীজের ফলন বাড়ানো এবং রফতানিতে আরও গতি আনা আগামি দিনে চ্যালেঞ্জ হতে চলেছে। দাবি গবেষকদের।
তাহলে সবমিলিয়ে বিষয়টা দাঁড়াল: বাজার অর্থনীতি আপাতত ইতিবাচক। কেরলের উপত্যকা জুড়ে হাসিমুখে চারা রোপণে নেমে পড়েছেন চাষিরা। সমাগত বসন্তে প্রেমের মরশুমে হাতে হাতে ডার্ক ক্যাডবেরি চালাচালিও বেড়ে চলুক। সক্কলে ‘হ্যাঁ’ শুনন, ‘হ্যাঁ’ বলুন প্রাণভরে।