শেষ আপডেট: 25th December 2024 12:38
দ্য ওয়াল ব্যুরো: 'স্বপ্ন, স্বপ্ন, স্বপ্ন... স্বপ্ন দেখে মন...'
নচিকেতা চক্রবর্তীর এই গানের লাইন হয়তো গুনগুন করেই সারাজীবন কাটিয়ে দেন মধ্যপ্রদেশের এই গ্রামের মহিলারা। কারণ ছোটবেলা থেকেই তাঁদের সব স্বপ্ন এবং ইচ্ছাশক্তিকে 'চেইন দিয়ে' বেঁধে রাখার রীতি চলে আসছে। কিন্তু বিশ্ব যখন ২০২৪ থেকে ২০২৫-এর দিকে ঢলে পড়ছে সেই সময় দাঁড়িয়ে এই রীতির বদল নয়, অবসান চায় গ্রামের মানুষ। খোলা আকাশে ভাবনাহীন পাখির মতো উড়ে বেড়াতে চান সেখানকার মহিলারা।
মধ্যপ্রদেশের রাজগড় জেলার জঠপুরা গ্রামের মহিলাদের জীবন কোনও রূপকথার মোড়কে মোড়া নয়। বরং জন্মানোর পরক্ষণ থেকেই তাঁদের সমাজের বন্দি বানিয়ে নেওয়া হয়। এই গ্রামে কারও কারও ২ বছর বয়সে বাগদান করিয়ে দেওয়া হয়, আর প্রায় সবারই ১৮ বছরের আগে বিয়ে! বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে এই 'নিয়ম'। এখন সেই গতেবাঁধা সংস্কারের অবসান চাইছেন সেইসব মহিলারাই যারা এই নিয়মের চোরাবালিতে পড়ে নিজেদের ছোটবেলার দিনগুলি হারিয়েছেন।
রমা বাই (৪০) নামের এক মহিলা জানিয়েছেন, ১০ বছরেই তাঁকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এখনও পর্যন্ত প্রতিদিনই কোনও না কোনও শিশুর বিয়ে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে, এটা বন্ধ হওয়া দরকার। গীতা, এখন যার ২২ বছর বয়স, তার বাগদান হয়েছিল ২ বছর বয়সে, বিয়ে ১৬-তে! এখন গীতার দুটি সন্তান আছে। তিনিও বলছেন, নিজের সন্তানদের সঙ্গে এমনটা কখনই করবেন না তিনি। আর চেষ্টা করবেন এটা দেখার যে কারও সঙ্গেই যেন এমনটা আর না হয়।
গ্রামের মহিলাদের একাংশ তো এমনও দাবি করেছেন, কিছু কিছু পরিবার সন্তানের জন্মের আগেই তাঁদের বিয়ে ঠিক করে ফেলে! কবে, কোন বয়সে, কার সঙ্গে বিয়ে হবে সব ঠিক করা হয়ে যায়। শুধু বিয়ে নয়, পণ নিয়েও দীর্ঘসময় ধরে আলোচনাপর্ব চলে। গোটা বিষয়টিই তাঁদের কাছে সমাজ-সংস্কারের মতোই।
এই রীতির জালে শুধু যে মহিলাদের শৈশব ফেঁসে আছে এমনটা নয়। ছোট ছোট ছেলেদের জীবনও নষ্ট হচ্ছে। কারও ১০ বছর, কারও ১২ বছরে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাদের মধ্যে অনেকেই বড় হয়ে ডাক্তার, লেখক, অভিনেতা হওয়ার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু গ্রামের বড়দের চাপিয়ে দেওয়া জীবনের ভারে পিষে যাচ্ছে তাঁদের সমস্ত ইচ্ছা, ভাবনা, চাহিদা।
গ্রামের একটা বড় অংশ আবার এই রীতিকেই বাহবা দিয়ে আসছেন। তাঁদের কাছে এটি আবশ্যিক ব্যাপার যাতে দেনা মেটানো যায়, বিয়ের খরচও বাঁচানো যায়। কিন্তু তাঁদের এই সিদ্ধান্তের বিরাট মূল্য দিতে হচ্ছে ওই গ্রামের ছোট ছোট প্রাণগুলিকে। ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেল্থ সার্ভে ৫-এর রিপোর্ট বলছে, রাজগড়ে ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সি অন্তত ৪৬ শতাংশ মহিলাদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় ১৮ বছরের আগেই। তাঁদের শিক্ষার দিকে কোনও জোরই দেওয়া হয় না। সেই কারণে গ্রামের অর্ধেকের বেশি মহিলারাই লেখাপড়া জানেন না।
কোনও মহিলা বা পরিবার যদি আবার এই নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় তাহলে তাঁদের গ্রামের নিজস্ব কাউন্সিল তলব করে। সেখানে তাঁদের জবাবদিহি করতে হয়। কেউ যদি বিয়ে ভাঙে তাহলে তাঁকে জরিমানা পর্যন্ত করা হয়। তবে শুধু জঠপুরা নয়, এই গল্প আরও অন্তত ৫০ গ্রামের, যেখানকার কমপক্ষে ৭০০ শিশুদের শৈশব এইভাবে বেঁধে রাখা হয়েছে কড়া নিয়মের শিকল দিয়ে।
এইসব গ্রামের মহিলাদের জন্য সময় যেন থেমে রয়েছে। তারা যেন বহু শতাব্দী আগের অতীতের কোনও অধ্যায়ে বেঁচে রয়েছেন। তাঁদের জন্য ফের ঘড়ির কাঁটা চলতে শুরু করলে হয়...