ফরহাদ মজাহার
শেষ আপডেট: 7th December 2024 09:31
অমল সরকার
৫ অগস্ট বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর শুরু হওয়া অস্থিরতা এখনও বিদ্যমান। রাজনৈতিক সন্ত্রাস, বিশেষ করে আওয়ামী লিগের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের উপর হামলার ঘটনায় কিছুটা হ্রাস টানা গেলেও সংখ্যালঘুদের উপর নিপীড়ন, নির্যাতন এখনও বন্ধ হয়নি। পাশাপাশি শুরু হয়েছে ভারত বিরোধী জিগির। ভারত বিরোধিতার নামে সংখ্যালঘুদের উপর হামলা, ঘরবাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেই চলেছে।
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের চলমান ঘটনাবলী নিয়ে ‘দ্য ওয়াল’ কথা বলেছে সে দেশের বিশিষ্ট্য কবি, দার্শনিক, মানবাধিকার সংগঠক ও পরিবেশবাদী ফরহাদ মজাহারের সঙ্গে, চার মাস আগে সংঘঠিত গণ অভ্যুত্থানের তরুণ নেতৃত্ব যাঁর ভাবশিষ্য হিসাবে পরিচিত। বৃহস্পতিবার ঢাকায় প্রধান উপদেষ্টা মহম্মদ ইউনুসের সামনে তিনি জোরালো কণ্ঠে প্রশ্ন তোলেন, কী এমন অপরাধ করেছে যে হিন্দু সাধু চিন্ময়কৃষ্ণ দাসকে জামিন না দিয়ে সরকার জেলে আটকে রেখেছে?
ঢাকা থেকে টেলিফোনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক, দুই দেশের মৌলবাদী ও প্রগতিশীল শক্তির বর্তমান অবস্থা, আওয়ামী লিগের ভবিষ্যৎ এবং শেখ হাসিনাকে নিয়ে ভারত সরকারের অবস্থান সম্পর্কে নিজের অভিমত জানিয়েছেন। শুনিয়েছেন অভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁর ভাবনা এবং সংখ্যালঘুদের অবদান ও তাদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির কথা। নীচে সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত অংশ।
‘এটা লজ্জার কথা খুনি শেখ হাসিনাকে ভারত
আশ্রয় দিয়েছে, ভারতের জনগণ প্রতিবাদ করছে না’
শেখ হাসিনাকে আমরা তাড়িয়ে দিয়েছি। তিনি একজন খুনি। তাঁর নির্দেশে পুলিশ শত শত মানুষকে হত্যা করেছে। এটা অত্যন্ত লজ্জার কথা ভারতের জনগণ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করছে না, যা আমরা আশা করেছিলাম।
কিন্তু ভারত সরকারের মনে রাখতে হবে, ৫ অগাস্ট পরবর্তী বাংলাদেশ একটা নতুন দেশ। এটা শেখ হাসিনার বাংলাদেশ নয়। পশ্চিমবঙ্গ, ভারতের মানুষ যদি জুলাই-অগাস্ট মাসের গণতান্ত্রিক উপায়ে সংঘঠিত অভ্যুত্থানকে নসাৎ করে চলেন তাহলে দু-দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়া কঠিন। বাংলাদেশের মানুষের অবদানকে মানতে হবে যে তারা একটি স্বৈরাচারী শাসককে ক্ষমতা থেকে উৎপাটিত করেছে। পশ্চিমবঙ্গের যারা আমাদের রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করছেন তাঁরা গণ অভ্যুত্থানকে অস্বীকার করতে চাইছেন কেন? এটা তো ফ্যাক্ট যে গণ অভ্যুত্থান ঘটে গেছে।
ফলে বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গত প্রশ্ন হল কেন ভারত একজন খুনিকে আশ্রয় দিয়েছে। এর একটাই কারণ হতে পারে যে ভারতের বর্তমান হিন্দুত্ববাদী শক্তি গণ অভ্যুত্থানকে নস্যাৎ করে শেখ হাসিনাকে আবার ক্ষমতায় আনতে চায়। তারা যদি এই চেষ্টা চালিয়ে যান তাহলে বাংলাদেশে উগ্রবাদী, ইসলামপন্থী দলের আরও উত্থান অবশ্যম্ভাবী। কারণ তারাই হিন্দু বিরোধী, ভারত বিরোধী শক্তি। হিন্দু মাত্রেই ভারতের দালাল, ইসকন মাত্রেই ভারতের দালাল, এই প্রচার তারা আরও জোরালো ভাবে করবে।
বিজেপি এবং উগ্র ইসলামপন্থী দল একই
বাংলাদেশে ভারত বিরোধিতায় লাগাম দিতে ভারতের জনগণের উচিত ছিল বাংলাদেশের মানুষের গণ অভ্যুত্থানকে সমর্থন করা, তাদের পাশে থাকা, যাতে মৌলবাদকে আমরা মোকাবিলা করতে পারি। ভারতের মানুষ বুঝতেই পারছে না যে বাংলাদেশে একটা গণতান্ত্রিক শক্তির উত্থান ঘটেছে। যারা একটা গণতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটিয়েছে। কিন্তু ভারতের জনগণ সেই সত্যকে অস্বীকার করে সম্পূর্ণ উল্টোটা করছে। তারা উগ্র ইসলামপন্থী শক্তিকে ক্ষমতায় বসাতে প্রাণপণ চেষ্টা করছে। ফলে বোঝাই যাচ্ছে, বিজেপি এবং উগ্র ইসলামপন্থী শক্তি একই। তারা একই লক্ষ্যে কাজ করছে। ভারতে থাকতে চাইছে উগ্র হিন্দুত্ববাদী শক্তি। অন্যদিকে, বাংলাদেশে একটা উগ্র ইসলামপন্থী থাকবে এবং জনগণকে নিয়ে তারা ফুটবল খেলবে। একজন লাথি মারবে, আর একজন পাল্টা লাথি মারবে।
ভারতে মসজিদের নীচে শিবলিঙ্গ খোঁজা হলে বাংলাদেশে
উগ্র ইসলামপন্থীদের কীভাবে মোকাবিলা সম্ভব?
ভারতে যদি প্রতিটি মসজিদের নীচে শিব লিঙ্গ খোঁজার চেষ্টা হয় তাহলে আপনারা কি মনে করেন বাংলাদেশে আমরা উগ্র ইসলামপন্থীদের মোকাবিলা করতে পারব? বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে এই ভারত কী করে তাদের মিত্র হতে পারে!
গণ অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে উগ্র ইসলামিক শক্তির উত্থান
এটা বাস্তব বাংলাদেশে এই সমস্যা আছে। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের নামে হাসিনা একবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সেনাপতি হয়ে ইসলামপন্থীদের দমনপীড়ন করেছেন। ফলে তাদের মধ্যে তো ক্ষোভ রয়েছেই। পরে আবার ইসলামপন্থীদের নিয়ে তিনি দেশ শাসন করেছেন। ফলে নানা ধরনের শক্তি আমাদের সমাজের মধ্যে রয়েছে। এটা তো অস্বীকার করার নয়। কিন্তু গণ অভ্যুত্থানও একটা বাস্তবতা যা সব ধরনের বৈষম্যের অবসানের কথা বলেছে। তাই আমরা সব ধরনের জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছি। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, হিন্দু জাতীয়তাবাদ, ইসলামিক জাতীয়তাবাদ—সবই এক ধরনের ফ্যাসিবাদ।
চিন্ময়কৃষ্ণকে গ্রেফতার, ভারত-বাংলাদেশে উত্তেজনা
চিন্ময়কৃষ্ণের গ্রেফতারি নিয়ে একটা উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল। প্রধান উপদেষ্টার ডাকা বৈঠকে আমি বলেছি, এটা গণ অভ্যুত্থানের স্পিরিটের বিরুদ্ধে। গণ অভ্যুত্থান বৈষম্যের অবসানের কথা বলেছে। চিন্ময়কৃষ্ণকে গ্রেফতারে বৈষম্য আরও বেড়ে গেল। সনাতন ধর্মের মানুষের তো নিজেদের কথা বলার অধিকার আছে। তারাও শেখ হাসিনাকে উৎখাত করতে গণ অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিল। নতুন বাংলাদেশ গঠনে তারাও ভূমিকা রাখছেন। আমরা চাই সরকার সংখ্যালঘুদের দাবিদাওয়াগুলি শুনুক।
সংখ্যালঘুরা এতদিন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় ছিলেন। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে তারা ধর্মের ভিত্তিতে সংঘঠিত হচ্ছেন। এতে তো অপরাধ কিছু নেই। তাদের আট দফা দাবিদাওয়া নিয়ে সরকার আলোচনা করলেই পারত।
আবার সেই গ্রেফতারির ঘটনা নিয়ে ভারতীয় মিডিয়া এমন প্রচার করল যে সীমান্তে হামলা, বাংলাদেশের দূতাবাস আক্রান্ত হল। এতে যেটা হল, বাংলাদেশে উগ্রবাদীদের মোকাবিলা করা আমাদের পক্ষে কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা থাকবে, না থাকবে না
ধর্মনিরপেক্ষতা একটি পশ্চিমি ধারণা। ইউরোপের ইতিহাসে ধর্ম বনাম ধর্মনিরপেক্ষতার যে বিভাজন তা আমাদের এখানে কখনই ছিল না। যান্ত্রিকভাবে সেক্যুলারিজম ধারণ করার কোনও অর্থ হয় না। বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি ক্ষতির কারণ হয়েছে। ১৯৭১-এ আমরা যখন যুদ্ধ করেছিলাম তখন তিনটি জিনিস চেয়েছিলাম, সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায় বিচার। এই তিনটি নীতিকে সম্পূর্ণ নস্যাৎ করে আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয় বাঙালি জাতীবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হলে আলাদা করে সেক্যুলার হওয়ার দরকারটা কী? বাংলাদেশে সেক্যুলারিজম এসেছে মূলত ইসলাম নির্মূল রাজনীতি হিসাবে। সেই সঙ্গে স্থানীয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্যকে অস্বীকার করার জন্য। বাংলার ভক্তি আন্দোলন কি সেক্যুলার মুভমেন্ট ছিল না? শ্রীচেতন্য, লালন ফকিরের আন্দোলন কি সেক্যুলার আন্দোলন নয়? বাংলাদেশের মানুষ সেক্যুলারিজমকে সন্দেহের চোখে দেখে। ফলে পশ্চিমবঙ্গ, ভারত আর বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা এক নয়। এমনকী ভারতের সংবিধানেও গোড়ায় ধর্মনিরপেক্ষতা কথাটি ছিল না।
হাসিনা-আওয়ামী লিগ-বিএনপি’র ভবিষ্যৎ
নির্বাচন করে আর একটা দলকে ক্ষমতায় এনে লুটেপুটে খাওয়ার সুযোগ করে দিতে গণ অভ্যুত্থান হয়নি। শত শত মানুষ জীবন দিয়েছে। হাজার হাজার ছেলেমেয়ে পঙ্গু জীবন কাটাচ্ছে। আমরা তাদের প্রত্যাশাকে নসাৎ করে দিতে পারি না। নতুন সংবিধান প্রণয়নের আগে আমরা একটা গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করতে চাই, যাতে সংবিধানটি কেমন হওয়া দরকার সে ব্যাপারে জনগণ তাদের বিচার-বুদ্ধি-বিবেচনা মতো নিজেদের কথা বলবে। তাতে বিএনপি, জামাত, সব দল অংশ নিতে পারে। সব দলকে বুঝতে হবে বিপ্লব পরবর্তী বাংলাদেশে তাদেরও বদলাতে হবে। বিএনপি যদি ক্ষমতা দখলের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে তাহলে আওয়ামী লিগের মতোই ভুল করবে। তেমন হলে জনগণ তাদেরও দূরে ঠেলে দেবে। রাজনৈতিক দলগুলির পুরনো কাঠানো এবং সংস্কৃতি দিয়ে নতুন বাংলাদেশ গড়া যাবে না। রাজনৈতিক দল ও ধনীদের ক্লাবের মধ্যে ফারাক স্পষ্ট করতে হবে। আওয়ামী লিগের যে অংশ স্বচ্ছ রাজনীতি করে এসেছে তারাও নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে স্বাগত।
শেখ হাসিনার রাজনীতিতে ফিরে আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ। ভারতের যারা তাঁকে ফেরানোর চেষ্টা করছেন তারা মুর্খের স্বর্গে বাস করছেন। সেটা ভারতের জন্যও ভাল হবে না। হাসিনা ফিরলে উগ্র ইসলামিক শক্তি বাংলাদেশে আরও মাথাচাড়া দেবে, যা ভারতেরও বিপদ ডেকে আনবে।