সৈয়দ আদিল হুসেন শাহ
শেষ আপডেট: 23 April 2025 08:52
দ্য ওয়াল ব্যুরো: প্রতিদিনের মতো গতকাল সকালেও সাধের টাট্টুঘোড়াটিকে নিয়ে বৈসরন উপত্যকায় (Baisaran Valley) পৌঁছে যান আদিল হুসেন শাহ (Syed Adil Husain Shah)। রাস্তায় ধস। লোকে আটকা পড়েছে। খবর আসছিল নিরন্তর। দোকানবাজারও বাকি দিনের মতো জাঁকিয়ে বসেনি।
কিন্তু এই জনবিরলতা যে বিকেল গড়াতে অন্য চেহারা নেবে, ঘুণাক্ষরেও তার আন্দাজ পাননি আদিল। সাড়ে তিনটে নাগাদ গুলিচালনার গমগমে আওয়াজ আর মানুষের চিৎকার উপত্যকার বুক চিড়ে দিগ্বিদিক ছড়িয়ে পড়ে। আদিল তখন কার পার্কিংয়ের কাছে চক্কর কাটছেন। কিছু বুঝে ওঠার আগে দেখতে পান চোখের সামনে এক জঙ্গি। বন্দুক উঁচিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে পর্যটকদের দিকে।
সেই মুহূর্তে নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি আদিল। কালক্ষেপ না করে ছুটে যান। কেড়ে নিতে চান জঙ্গির (Terrorist) হাতের উদ্যত বন্দুক। তখনই হাতাহাতি। আর তার জেরে বুলেটের আঘাতে প্রাণ হারান তিনি। নিশানায় না থেকেও এক নিরীহ পর্যটকের প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে চূড়ান্ত টার্গেট আদিল শাহ। মৃত ২৬ জনের তালিকায় নাম রয়েছে এই কাশ্মীরি ঘোড়াচালকেরও।
ভরা এপ্রিলে সবুজ গালিচায় ছেয়ে থাকে পহেলগামের বৈসরন উপত্যকা। ঢেউ খেলে যাওয়া জমি। চারদিক পাইন গাছে ঘেরা। ডালপালার ফাঁক গলে উঁকি মারে ধ্যানগম্ভীর হিমালয়। এক নজরে গোটা অঞ্চলকে সুইজারল্যান্ড বলে ভুল করতে পারেন যে কেউ।
পর্যটনের মরশুমে সারা দেশের হাজারো পর্যটকের স্বপ্নের গন্তব্য বৈসরন ভ্যালি। এমনিতে দুর্গম না হলেও কাশ্মীরের এই ছবির মতো সুন্দর উপত্যকা পৌঁছনটা বেশ কষ্টসাধ্য। অনন্তনাগে নেমে পহেলগাম হয়ে বৈসরন যেতে হলে পায়ে হেঁটে বা ঘোড়ার পিঠে চড়া ছাড়া উপায় নেই। তবু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টানে এই উপত্যকায় ভিড় জমান সকলে। কেউ মেতে ওঠেন স্কি ডাইভিংয়ে। কেউ রেস্তরাঁ বা ছোটখাট ঠেলাগাড়িতে খাওয়াদাওয়া সারেন। কেউ আবার ঘোড়ায় চড়ে ইতিউতি ঘুরে বেড়ান।
গতকাল জঙ্গি হামলার (Pahalgam Terrorist Attack) পর একটা আস্ত উপত্যকার চেহারা পালটে গিয়েছে। ছাব্বিশ জন নিরীহ নাগরিকের মৃত্যুর রেশ রাজনীতিক, কূটনীতিক আবহে কতটা ছাপ ফেলবে সেটা ক্রমশ বোঝা যাবে। কিন্তু এর জেরে স্থানীয় বাসিন্দাদের রুজিরুটির ভবিষ্যৎ যে ক্রমশ তলানিতে ঠেকবে তার ধাক্কা এখনই বুঝতে শুরু করেছেন সৈয়দ আদিল হুসেন শাহর পরিবার।
আদিল পেশায় ঘোড়াচালক। পর্যটকদের মনোরঞ্জন করতে ঘোড়া নিয়ে বৈসরন উপত্যকায় ছুটে যেতেন হররোজ৷ গতকাল হামলার সময় অকুস্থলেই ছিলেন। গুলিচালনার আওয়াজ শুনে ছুটে যান। আর তাতেই প্রাণ হারান আদিল।
পরিবারের একমাত্র রোজগেরে সদস্য ছিলেন তিনি৷ বাড়িতে বৃদ্ধ বাপ-মা রয়েছেন। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে শোকে পাথর দম্পতি। অকুল পাথারে হাবুডুবু খাচ্ছেন। একদিকে সন্তানকে হারানোর যন্ত্রণা। অন্যদিকে আগামীকাল সংসার চলবে কীভাবে, দানাপানি জোটাবে কে—এই প্রশ্নও দাঁতনখ বের করে এগিয়ে আসছে। কোনও জবাব নেই। নেই ন্যূনতম আশার আলো। তাই নাশকতাকে নিশানা করেই প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন আদিলের বাবা সৈয়দ হায়দার শাহ। বলেছেন, ‘আমার ছেলে আর সবার হয়ে রোজগার করত৷ কাল বিকেল তিনটের দিকে আক্রমণের খবর শুনি। শুনেই ওকে ফোন করি। কিন্তু ফোন সুইচড অফ ছিল৷ সাড়ে চারটে নাগাদ চালু হয়৷ কিন্তু কেউ জবাব দেয়নি। তারপর আমরা থানায় ছুটে যাই৷ তখনই জানতে পারি, আদিল জঙ্গিহানায় আহত। তারপর মারা যায় ও। আমার ছেলেই রোজগার করত। এবার কী হবে? আমরা এই মৃত্যুর বিচার চাই। যারা এর জন্য দায়ী, তাদের ফল ভুগতেই হবে।’
আদিলের মা ততক্ষণে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। কোনওক্রমে বলেন, ‘আমার ছেলেই পরিবারের একমাত্র অবলম্বন ছিল। ঘোড়া চালিয়ে রোজগার করত। এখন আমাদের খাওয়ানো-পরানোর কেউ থাকল না। জানি না ওকে ছাড়া কীভাবে চলবে!’
একই সুর মহিদ্দিন শাহর। সম্পর্কে আদিলদের আত্মীয়। বললেন, ‘আমরা ওই এলাকারই বাসিন্দা। আদিল খুবই গরিব ঘরের ছেলে। ওর মৃত্যুর জেরে গোটা পরিবার পথে বসল। আমরা সরকারের কাছে আর্জি জানাচ্ছি যাতে ঘটনার স্বচ্ছ ও পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হয়৷ আদিলদের মতো নিরীহ স্থানীয়দের যেন আর মারা যেতে না হয়। আমরা ন্যায়বিচার চাই।’
এই বিচারের দাবিতেই আজ রাজ্যজুড়ে বন্ধের ডাক দিয়েছে কাশ্মীরের বণিকসভা চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ কাশ্মীর (সিসিআইকে)। সামিল হয়েছে নাগরিক সমাজ। বেরিয়েছে মোমবাতি মিছিল। যেখান থেকে আওয়াজ উঠেছে: ট্যুরিস্ট হামারি জান হ্যায়! নিরপরাধদের খুন বন্ধ করো!'