শেষ আপডেট: 30th January 2025 13:34
দ্য ওয়াল ব্যুরো: মহারাষ্ট্রে হু হু করে ছড়িয়ে পড়ছে গুলেন বারি সিনড্রোম (Guillain Barre)। ইতিমধ্যেই ১১০ জন রোগীর খবর মিলেছে। মারাও গেছেন বেশ কয়েক জন। মহারাষ্ট্রে সূত্রপাত হলেও, বাংলাও এই অসুখের থাবা থেকে দূরে নেই। মৃত্যুও হয়েছে এক শিশু, এক কিশোর ও এক প্রৌঢ়ের।
সব মিলিয়ে, এই নতুন বিরল অসুখ বেশ বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে গত কয়েক দিনে।
কোনও ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের সংক্রমণের পরে, শরীরের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করার পরিবর্তে ভুল করে শরীরের ভিতরের স্নায়ুগুলোকে আক্রমণ করে। এর মূল কারণ হল, ক্যাম্পাইলোব্যাক্টার নামক একটি জীবাণু, যা দূষিত খাবার ও পানীয়র মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে। প্রাথমিক ভাবে ডায়রিয়া হয়। তার পরেই গুলেন বারি।
চিকিৎসকরা জানান, গুলেন বারির রোগীরা প্রথমে হাতে-পায়ে দুর্বলতা অনুভব করে, পরে তা ধীরে ধীরে সারা শরীরে ও শ্বাস-প্রশ্বাসের পেশিগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে। ফলে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।
এটাই গুলেন বারির সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক। শ্বাস-প্রশ্বাসের পেশিগুলোর ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়তে পড়তে যখন ডায়াফ্রামও (শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণকারী প্রধান পেশি) দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন রোগী ঠিকমতো শ্বাস নিতে পারে না। ফুসফুস থেকে কফ বের করতেও কষ্ট হয়, যা নিউমোনিয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।
স্বাভাবিকভাবে রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা আমাদের বিভিন্ন রোগের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয়, কিন্তু GBS-এ এটি উল্টো নিজের স্নায়ুতন্ত্রকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে। এ কারণে একাধিক স্নায়ু আক্রান্ত হয়। তাই রোগটি ‘Acute Inflammatory Demyelinating Polyneuropathy (AIDP)’ নামেও পরিচিত।
দিল্লির বিশিষ্ট নিউরোসার্জন ডা. সঞ্জীব কুমার ঝা জানিয়েছেন, এই আকস্মিক স্নায়ুরোগ হঠাৎ করেই শরীরে আঘাত হানে এবং স্নায়ুগুলো ফুলে যায়। ডাক্তারবাবু ব্যাখ্যা করেন, আমাদের শরীরের স্নায়ুগুলির উপরে মাইলিন শিট নামে একটি সুরক্ষা-স্তর থাকে, যা স্নায়ুগুলোর স্বাভাবিক কার্যকারিতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গুলেন বারির ক্ষেত্রে, শরীরের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা ভুল করে এই মাইলিন শিটকেই আক্রমণ করে, যার ফলে ‘ডিমাইলিনেশন’ অর্থাৎ মাইলিনের ক্ষয় শুরু হয়।
এমআরআই এবং নার্ভ কন্ডাকশন ভেলোসিটি টেস্ট করার পরে তবেই ধরা পড়ে এই অসুখ।
গুলেন বারির প্রাথমিক লক্ষণগুলি হল, পায়ের পেশিতে দুর্বলতা, অসাড় ভাব। এই অনুভূতি বাড়তে বাড়তে, হাঁটতে অসুবিধা হয়। হাত-পা নাড়াতে সমস্যা হয়।
পরবর্তী ধাপে গুরুতর লক্ষণগুলি হল, মেরুদণ্ড দুর্বল হয়ে পড়া, মুখাবয়ব পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যাওয়া, বুকে ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট, কথা বলতে ও খেতে অসুবিধা, দৃষ্টিশক্তির সমস্যা, শরীরের ভারসাম্য হারানো-- ইত্যাদি।
তবে গুলেন বারি দ্রুত ছড়িয়ে পড়লেও, ৮০% রোগী এক সপ্তাহের মধ্যে স্থিতিশীল হয়ে যান, তবে ২০% রোগীকে ভেন্টিলেটরে রাখা প্রয়োজন হয়।
চিকিৎসকরা বলছেন, গুলেন বারি কখনওই পুরোপুরি প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়, তবে কিছু সাবধানতা গ্রহণ করলে ঝুঁকি কমানো যায়।
কীভাবে সতর্ক থাকবেন?
ভালভাবে হাত ধোয়া: হাত ধোয়ার মাধ্যমে ফুসফুস ও অন্ত্রের সংক্রমণ কমানো যায়।
খাবার ভালভাবে রান্না করা: বিশেষ করে ক্যাম্পাইলোব্যাক্টার জেজুনি ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ প্রতিরোধ করা দরকার।
সংক্রমণের দ্রুত চিকিৎসা: ডায়রিয়া বা শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।
টিকা পর নজর রাখা: টিকা নেওয়ার পর মাংসপেশির দুর্বলতা বা অবশ লাগলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া।
গুলেন বারি অসুখের কোনও নির্দিষ্ট ওষুধ নেই, তবে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করলে জটিলতা কমানো সম্ভব। অসুখ যদি গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছয়, তাহলে যে যে পদ্ধতিতে চিকিৎসা হয়ে থাকে:
প্লাজমাফেরেসিস (Plasmapheresis): গুলেন বারি সৃষ্টি করা অ্যান্টিবডি রক্ত থেকে সরানো হয়।
আইভিআইজি (Intravenous Immunoglobulin) থেরাপি: রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা স্বাভাবিক করতে বিশেষ প্রোটিন দেওয়া হয়।
ভেন্টিলেটর সাপোর্ট: যদি রোগী শ্বাস নিতে না পারে, তবে কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র ব্যবহার করা হয়।
ফিজিওথেরাপি: পেশির কার্যকারিতা পুনরুদ্ধারে নিয়মিত ব্যায়াম ও থেরাপি প্রয়োজন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, গুলেন বারি আক্রান্তদের মধ্যে ৫% পর্যন্ত রোগী মারা যেতে পারেন, যদি সঠিক সময়ে চিকিৎসা না দেওয়া হয়।
ইমিউনোগ্লোবুলিন থেরাপি
এই পদ্ধতিতে রোগীর শরীরের ওজন অনুযায়ী ৫ দিন ধরে ইনজেকশন দেওয়া হয়।
সাধারণত, প্রতিদিন ৪-৬টি ইনজেকশন প্রয়োজন হয়।
প্রতিটি ইনজেকশনের খরচ প্রায় ১৫,০০০ টাকা হওয়ায় চিকিৎসা ব্যয়বহুল।
প্লাজমাফেরেসিস (Plasmapheresis)
এটি ডায়ালিসিসের মতো একটি চিকিৎসা পদ্ধতি, যা রোগীর রক্তের প্লাজমা পরিবর্তন করে ক্ষতিকর অ্যান্টিবডি দূর করে।
পুরো চিকিৎসা ১০ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
এই প্রক্রিয়ার আনুমানিক খরচ ২ থেকে ২.৫ লক্ষ টাকা।
গুলেন বারি সিন্ড্রোম সাধারণত ২-৩ সপ্তাহ স্থায়ী হয়। চিকিৎসার পর পুরোপুরি সুস্থ হতে ৩-৪ সপ্তাহ সময় লাগতে পারে। সময়মতো চিকিৎসা শুরু করা হলে ৬০-৭০ শতাংশ রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন।
তবে, কিছু ক্ষেত্রে রোগের অবস্থা গুরুতর হলে ভেন্টিলেটর সাপোর্টের প্রয়োজন হতে পারে, এমনকি রোগী মৃত্যুমুখেও পৌঁছাতে পারেন। তাই চিকিৎসকরা জোর দিয়ে বলছেন, যে কোনও উপসর্গ দেখা দিলেই দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা অত্যন্ত জরুরি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে, গুলেন বারি কোনওভাবেই ছোঁয়াচে বা বংশগত রোগ নয়। তবে, যদি রোগী চার সপ্তাহের মধ্যে দুর্বল হয়ে পড়েন, তাহলে ভ্রমণ এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়। কারণ, এটি হঠাৎ পক্ষাঘাত সৃষ্টি করতে পারে এবং রোগীকে যে কোনও সময় ভেন্টিলেটরের প্রয়োজন হতে পারে।