শেষ আপডেট: 19th July 2024 13:10
দ্য ওয়াল ব্যুরো: সোনা পাচার নিয়ে অসংখ্য চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে বলিউড-হলিউডে। নিত্যনতুন কৌশলে সমস্ত অণুবীক্ষণ যন্ত্রকে ফাঁকি দিয়ে আজও একইভাবে বিশ্বজুড়ে অবিরাম সোনা পাচার চলছে। ভারতও তার বাইরে নয়। সম্প্রতি বলি-হিট ছবি ক্রু-তেও সোনা পাচারের সূক্ষ্ম কলাকৌশল তুলে ধরা হয়েছে। বহুমূল্যের এই ধাতু পাচার নিয়ে লোকমুখেও প্রচুর মশলাদার উপাদানে ভরা গপ্প ঘুরে বেড়ায়। কী আছে এই সোনা পাচারের পিছনে? কারা রয়েছে পাচারের কারসাজিতে? কেন সোনা পাচার চেষ্টা করেও রোখা সম্ভব নয়? আন্তর্জাতিক এই পাচারচক্রের অন্তরালে কারা রয়েছে?
পেনের রিফিলে সোনার ধুলো ভরে, স্যানিটারি প্যাডে কিংবা ডায়াপারে লুকিয়ে সোনা একদেশ থেকে ভিনদেশে পাড়ি দেয়। সোনাকে গলিয়ে বা ঢালাই করে স্যুটকেসের চাকায় ভরে, ভালভ তৈরি করে এবং বৈদ্যুতিন যন্ত্রাংশ করে চলে যায় এক দেশ থেকে অন্য দেশে। আর ক্যাপসুলের আকার করে মানবশরীরের গোপনাঙ্গে ভরে পাচার তো পুরনো ব্যাপার। পাচারের জন্য রোজ নতুন করে পদ্ধতি 'আবিষ্কার' করতে হয়। একটি পদ্ধতি কিছুদিন চললে বদল হয় কৌশলের।
ডিরেক্টরেট অফ রেভিনিউ ইন্টেলিজেন্স বা ডিআরআই-এর তথ্য বলছে ভারতে সোনা পাচার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। ডিআরআই এবং শুল্ক বিভাগের সূত্রে জানা গিয়েছে, কিছু সোনা পাচারের ঘটনা ধরা গেলেও বহু ক্ষেত্রে টের পাওয়াই যায় না। পাচারকারীদের মধ্যে অটুট সমন্বয়, এয়ারলাইন্স এবং বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের যোগসাজশ ও বোঝাপড়ায় এই চক্র বছরের পর বছর চলছে।
এই মাসেই স্থলপথে পূর্ব লাদাখের চিন সীমান্ত বরাবর ১০৮ কেজি সোনা ভারতে পাচারের সময় ধরা পড়ে। যার মূল্য ৮২ কোটি টাকা। কিন্তু কারা রয়েছে তা ধরা পড়েনি তবে বোঝা যাচ্ছে এই পথ ধরে এর আগে দুবার পাচার হয়েছিল, তা জানাই যায়নি। শুল্ক দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, এগুলির মধ্যে সুইৎজারল্যান্ড, হংকং, দুবাই ও বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশের ১৭ রকমের সোনার বিস্কুট ছিল। এগুলি চিনে এসে জমা হয়। সেখান থেকে পাহাড়ি গিরিখাদ ধরে ভারতে ঢুকেছিল।
সূত্রে আরও জানা গিয়েছে, কঠিন সোনা পাচারের কৌশল এখন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বদলে গিয়েছে। বিস্কুট আকারের বদলে ইদানীং রাসায়নিকভাবে রূপ বদলে সোনার ধুলো বা নরম পেস্ট তৈরি করে নেওয়া হচ্ছে পাচারের সুবিধায়। সংবাদমাধ্যম 'দ্য প্রিন্ট' ডিআরআই এবং শুল্ক বিভাগের বেশ কিছু সূত্রের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলে জেনেছে, পাচারপথেরও বদল হয় প্রায়শই। যেমন সমুদ্রপথে পাচারের রীতি আপাতত বদলে ফেলা হয়েছে। তারপর আকাশপথ, আর এখন স্থলপথকে বেশি নিরাপদ মনে করছে পাচারকারীরা।
তেমনই পাচারকারীদের ব্যক্তি পরিচয়েও বদল এসেছে। আগে খেতে না পাওয়া গরিবগুর্বো, শ্রমিক শ্রেণির মানুষকে সামান্য কমিশনে জল ও আকাশপথে পাচারের কাজে ব্যবহার করা হতো। এখন বিদেশি এবং উচ্চশিক্ষিত মানুষকে ক্যারিয়ার করা হচ্ছে, যাতে ধরা পড়ার ভয় কম থাকে। এখন আর সোনা লেনদেনে টাকার ব্যবহারও হয় না, সেই জায়গায় ব্যবহৃত হচ্ছে ডিজিটাল ওয়ালেট কিংবা ক্রিপ্টোকারেন্সি। ফলে, হদিশ পাওয়াই মুশকিল হয়ে যাচ্ছে।
ডিআরআইয়ের বিশেষজ্ঞদের কথায়, সোনা পাচার কেবল আর্থিক অপরাধই নয়, এতে পরোক্ষ কর এবং প্রত্যক্ষ কর সংগ্রহেও বিরূপ প্রভাব পড়ে। সোনা পাচারের চক্র সমান্তরাল অর্থনীতি চালায়। হাওলা নেটওয়ার্কে ইন্ধন জোগায়। ১৯৯২ সালে সোনা আমদানি যখন বৈধ হয়ে যায়, তখন কিছুকালের জন্য পাচার কমে এলেও ইদানীং তা আবার চাঙ্গা হয়ে গিয়েছে। তার অন্যতম কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার মূল্য চড়ে যাওয়ায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, আমদানি শুল্ক বৃদ্ধি, সরকারি নীতি এবং আইনের উপর নির্ভর করে পাচারের বাজার।
শুল্ক বিভাগের এক অফিসার বললেন, পাচার কমবে কী করে, আইন যে তেমন জোরাল নয়। শুল্ক বিভাগ তদন্ত করে একটি শোকজ নোটিস দিতে পারে। তথ্যপ্রমাণ হাতে পেলে ৬ মাসের মধ্যে ফৌজদারি অভিযোগ জমা হয়। তাতে যদি দোষী সাব্যস্ত হয়, তাহলেও সামান্য কয়েক বছরের জেল অথবা জরিমানার শাস্তি হয়। যে কারণে ইদানীং বিদেশি নাগরিক এবং শিক্ষিত ব্যক্তিদের ক্যারিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
তাঁর কথায়, বিমান সংস্থার কর্মীদেরও এই চক্রে যোগ করা হয়। সাম্প্রতিক সিনেমা ক্রু-তে যেমনটা দেখানো হয়েছে, তেমন করেই পাচার হয়ে থাকে। 'দ্য প্রিন্ট' লিখেছে, গত মে মাসে ডিআরআই এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেসের এক কেবিন ক্রুকে ধরেছিল। তিনি মাসকট থেকে ফিরছিলেন। কান্নৌর বিমানবন্দরে তাঁকে সন্দেহভাজন মনে করে আটক করা হয়। সুরভী খাতুন নামে কলকাতার ওই যুবতী মলদ্বারে ৯৬০ গ্রাম সোনা নিয়ে ফিরছিলেন।
সাবির আলি নামে এক ইউটিউবার চেন্নাই বিমানবন্দরে একটি দোকান ভাড়া নিয়েছিলেন। তিনি তাঁর কর্মীদের দিয়ে পাচার করতেন। জুনে তাঁকে পাকড়াও করা হয়। তাঁর ৭ জন কর্মীর কাছে ব্যুরো অফ সিভিল অ্যাভিয়েশনের সিকিউরিটি পাস থাকায় তাঁদের ঢোকা-বেরনোয় নিশ্ছিদ্র চেকিং হতো না। তাঁদের মারফত ওয়াশরুমের ভিতর সোনা হাতবদল হতো। শুল্ক বিভাগের অনুমান, তারা দুমাসের মধ্যে ২৬৭ কেজি সোনা পাচার করেছে। পুরোটাই ক্যাপসুল আকারে মলদ্বারে ঢুকিয়ে নিয়ে আসা। যার মূল্য ১৬৭ কোটি টাকা।
ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের রিপোর্ট বলছে, ভারতে পাচারকৃত সোনার ৪০-৪৫ শতাংশ ঢোকে পশ্চিমবঙ্গ, মণিপুর এবং মিজোরাম সীমান্ত দিয়ে। বাংলাদেশ, মায়ানমার এবং চিন থেকে এইসব সোনা আসে। ৩০-৩৫ শতাংশ আসে কেরল, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং তেলঙ্গানায়। এগুলি আসে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে।