Advertisement
চলছে নথি ডিজিটাইজ করার কাজ।
Advertisement
শেষ আপডেট: 8 July 2024 22:38
দ্য ওয়াল ব্যুরো: এই মুহূর্তে এদেশে এমন এক কাজ চলছে, যা বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রকল্প বলা যেতে পারে। সে কাজে ২৪ ঘণ্টা ধরে নিযুক্ত রয়েছেন একদল বিশেষজ্ঞ এবং সেনাবাহিনীর একটি বড় অংশ। মাস দুয়েকের মধ্যে আরও চারশো জন কর্মী এ কাজে যোগ দেবেন এবং ২০২৬ সালের মধ্যে এই কাজ শেষ করার চেষ্টা করা হবে।
এ প্রকল্প আর কিছুই নয়, গত প্রায় ১০০ বছরের ইতিহাসে যত নথি জমা রয়েছে সে সবের ডিজিটাইজেশন! দিল্লির সুবিশাল ন্যাশনাল আর্কাইভসের অন্দরে তাই উত্তেজনা তুঙ্গে। অফিসের দু'টি ফ্লোর জুড়ে চারশো তরুণ-তরুণী কোমর বেঁধে লেগে রয়েছেন, প্রাচীন থেকে প্রাচীনতর নথি ঘেঁটে বার করে সেসব ডিজিটাইজ করতে। সূত্রের খবর, মোট ৩৪ কোটিরও বেশি নথি রয়েছে সেখানে। এখন দৈনিক প্রায় চার লক্ষ করে পাতা ডিজিটাইজ করে ভরে ফেলা হচ্ছে কম্পিউটারের পেটে। লক্ষ্য, দৈনিক ৬ লক্ষে পৌঁছনো।
আর এই কাজ করতে গিয়েই হাতে পাওয়া যাচ্ছে, ঝাঁসির রানির চিঠি থেকে শুরু করে, লর্ড মাউন্টব্যাটেনের দেশভাগের পরিকল্পনার খসড়া, এমনকি মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করার পরে দায়ের হওয়া এফআইআর-এর আসল কপি! যা রীতিমতো শিহরন জাগানো বিষয় বলেই মনে করছেন এই কাজের সঙ্গে যুক্ত তরুণ-তরুণীরা।
প্রসঙ্গত, ভারতের আর্কাইভের অবস্থা খুব একটা ভাল নয়। বছরের পর বছর ধরে সরকারি উদাসীনতার কারণে নষ্ট হয়ে গেছে বহু অমূল্য ও জরুরি নথি। ন্যাশনাল আর্কাইভ অফ ইন্ডিয়া যে ডিজিটাইজেশনের কাজ শুরু করেছে, তা অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে। তবু, ইংরেজি প্রবাদবাক্য 'বেটার লেট দ্যান নেভার' মেনে, কাজ শুরু করেছে সরকার।
এই কাজের জন্য মোট ৭৫টি স্ক্যানার ইনস্টল করা হয়েছে, যেগুলির প্রত্যেকটি প্রতি আট ঘণ্টার শিফ্টে চার-পাঁচ হাজার পৃষ্ঠা করে স্ক্যান করছে। ২০-৩০ বছর বয়সি কয়েকশো তরুণ-তরুণীকে সপ্তাহ দুয়েকের প্রশিক্ষণ দিয়ে মোতায়েন করা হয়েছে। সারা দেশের নানা প্রান্ত থেকে এসে তাঁরা এ কাজে হাত লাগিয়েছেন, মাসিক ১৫-২০ হাজার টাকা বেতনের বিনিময়ে। দিনরাত এক করে তাঁরা কাগুজে নথি ডিজিটাইজ করে চলেছেন এবং সরকারি ওয়েব পোর্টালে আপলোড করে চলেছেন। জুন মাস পর্যন্ত প্রায় ৩ কোটি পৃষ্ঠা আপলোড করা হয়ে গেছে।
এই প্রকল্পের এখ তরুণ সদস্য অভিষেক কুমার বলছিলেন, এটিই তাঁর প্রথম কোনও কাজের সুযোগ। আর সেই কাজ যে এত রোমাঞ্চকর হবে, তা তিনি ভাবতেও পারেননি। কারণ অজস্র পুরনো নথি ঘাঁটতে ঘাঁটতে, আচমকাই তাঁর হাতে চলে আসে. ১৯৪৭ সালের ৩ জুনের কাগজটি। দেখে থমকে যান ২৬ বছরের অভিষেক। কারণ সেটি ছিল, লর্ড মাউন্টব্যাটেনের ভারত ভাগের প্রথম খসড়া! অভিষেকের কথায়, 'আমি এক মুহূর্তে ইতিহাসের স্রোতে ভেসে গেছিলাম। ছোটবেলা থেকে বইয়ে পড়েছি এই ভারত ভাগের কথা, তাই নিয়ে কূটনৈতিক পরিকল্পনার কথা। কিন্তু সেই নথির আসল কপি এভাবে চোখের সামনে দেখতে পাব, তা কোনওদিন ভাবতে পারিনি!' অভিষেক সেটির ছবিও তুলে রেখেছেন নিজের সংগ্রহে রাখবেন বলে, যদিও সংবেদনশীল নথি হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করেননি।
কয়েক ডজন স্ক্যানার এবং একরাশ পুরনো নথির স্তূপের মাঝে দাঁড়িয়ে আর এক কর্মী শশীভূষণ বলছিলেন, 'দেশের এত পুরনো সব রেকর্ড যখন আমাদের হাতে আসে, তখন দারুণ লাগে। কারণ এখন আমাদেরই দায়িত্ব সেগুলি ঠিক মতো পরিচালনা করে ডিজিটাইজ করার। আমার মনে হয় এটা একটা খুব বড় কাজ। কারণ এই এত বড় প্রক্রিয়া সারা বিশ্বে বিরল। আমি রোজ এমন ৫০-৬০টা করে নথি স্ক্যান করে ডিজিটাইজ করে আপলোড করি ওয়েবসাইটে।'
মোদী সরকারের সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রকল্পের অংশ, ন্যাশনাল আর্কাইভ অফ ইন্ডিয়ার ডিরেক্টর অরুণ সিংগান বলেন, 'আমাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ক্ষমতা সীমিত, তাই চাইলেও সর্বোচ্চ গতিতে কাজ এগোনো যাচ্ছে না। তার পরেও যতটা হচ্ছে, তাতে আমরা খুশি। আমাদের কাছে খুব পুরনো বিরল রেকর্ড রয়েছে, ভারতের বহু ঐতিহ্য আমাদের কাছে সুরক্ষিত রাখা রয়েছে। এসব আকর্ষণীয় নথি যেমন সংরক্ষণ কার দরকার, তেমনি আগামী দিনে মানুষের দেখাও দরকার। তাই সর্বোত্তম উপায় হল, সেগুলিকে স্ক্যান করা এবং ডিজিটাইজ করা।'
১৯৮৭ সালের আইএএস অফিসার অরুণ সিংগাল আরও বলেন, 'সেই নূরজাহানের সময়কার ডিক্রিপত্র রয়েছে আমাদের কাছে। আছে তুঘলক রাজবংশের আমলের কাগজপত্র। ঝাঁসির রানির চিঠি আছে, এমনকি সংবিধানের মূল কপিও আছে। আছে ১৯৩৬ সালে হিন্দি কবি জয়শঙ্কর প্রসাদের লেখা 'কামায়নী'র পাণ্ডুলিপিও। শুধু তাই নয়, মহাত্মা গান্ধী, চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী এবং রাজেন্দ্র প্রসাদের মতো ব্যক্তিত্বদের বহু ব্যক্তিগত নথিও রয়েছে আর্কাউভে। জওহরলাল নেহেরু, সর্দার প্যাটেল এবং শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর মতো বিশিষ্ট নেতাদের বহু চিঠিপত্র রয়েছে৷ এগুলি দেখলে আমি সবসময় রোমাঞ্চিত হই। মহাত্মা গান্ধীর খুনের পরে দায়ের হওয়া সেই আসল এফআইআরটি আমায় এখনও ধাক্কা দেয়।'
জানা গেছে, এই সুবিশাল কর্মকাণ্ড মোটেও সহজ নয়। প্রথমে কার্বক্সিমিথাইল সেলুলোজ জেল দিয়ে কাগজপত্র ব্রাশ করা হচ্ছে। তবে বেশিরভাগ কাগজই যেহেতু মুড়মুড়ে হয়ে গেছে, তাই সে কাজ করতে হচ্ছে খুব সাবধানে। এর পরে সেগুলি হাওয়ায় শুকিয়ে লেবেলিং করা হচ্ছে। তার পরে সেগুলি যাচ্ছে সেলাই হওয়ার জন্য। সেলাই করে গোছানোর পরে পাঠানো হচ্ছে ডিজিটাইজেশনের জন্য।
সিংগালের মতে, আর্কাইভের প্রায় ৫ কোটি পৃষ্ঠা অত্যন্ত ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে এবং ড্যাম্প ধরে, ছাতা গজিয়ে কালো কালো ছোপ পড়ে গেছে। ফলে সেগুলি এই মুহূর্তে ডিজিটাইজ করা জরুরি, নইলে সে সব বাঁচানো যাবে না।
Advertisement
Advertisement