ফেঙ্গল ঘূর্ণিঝড়।
শেষ আপডেট: 1st December 2024 10:40
দ্য ওয়াল ব্যুরো: শক্তিশালী থেকে অতি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়েছে ‘ফেঙ্গল’ (Cyclone Fengal)! বঙ্গোপসাগরের জলরাশি থেকে জলীয় বাষ্প সংগ্রহ করে ক্রমাগত শক্তি বাড়িয়ে প্রবল বেগে ধেয়ে গিয়েছে তামিলনাড়ু উপকূলে। শনিবার বিকেলে আছড়ে পড়ে শুরু করেছে তাণ্ডব। রবিবার ভোর সাড়ে ৫টার মধ্যে শক্তি হারিয়েছে ঘূর্ণিঝড়। তারপরে তা পরিণত হয়েছে গভীর নিম্নচাপে। তবে এর মধ্যেই তিনটি প্রাণ নিয়ে নিয়েছে এই ফেঙ্গল।
এই বছর এই ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করেছে সৌদি আরব। 'ফেঙ্গল' শব্দের অর্থ 'উদাসীন' বা 'অলস', যা একটি বিমুখ বা অনাসক্ত অবস্থাকে বোঝায়।
তবে কেবল এই ঝড় নয়, এর পরবর্তী ঝড়গুলোর নামও আগেই ঠিক হয়ে আছে। ২০২০ সালেই আইএমডি মোট ১৬৯টি ঝড়ের নামের একটি তালিকা করে রেখেছে, সেখানেই রয়েছে এই ফেঙ্গল ঝড়ের নাম৷ এর আগে যে নাম কাতার দিয়েছিল, তা হল 'দানা'। একমাস আগেই সে ঝড় হয়ে গেছে। এর পরে যে ঝড় আসছে, তাদের নাম শ্রীলঙ্কার 'শক্তি' এবং থাইল্যান্ডের 'মন্থা', সংযুক্ত আরবের 'সেন-ইয়ার', ইয়েমেনের 'দিতওয়া'।
১৯ শতকের শুরুর দিকে ঝড়ের নামকরণের এত ধুম ছিল না। যে বছর ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে কখনও সেই সাল দিয়ে আবার কখনও সাধু সন্তদের নামেই ঝড়ের নামকরণ করা হত। পরের দিকে যেখানে যেখানে ঘূর্ণিঝড় হত সেই জায়গার নামেই সাল জুড়ে দিয়ে ঝড়ের নাম হত। যেমন, '১৮৬৪ ক্যালকাটা সাইক্লোন'।
আরও একটা মজার উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা বোঝা যাবে। আটলান্টিক মহাসাগরে একবার একটা ঝড় আছড়ে পড়েছিল যার নাম 'আন্তজের হারিকেন'। জানা গেছে, এরকম নামের কারণ আর কিছুই নয়। সেই ঝড়ে আন্তজে নামের একটা জাহাজের মাস্তুল ভেঙে দিয়েছিল! সেই স্মৃতিতে এই নামকরণ হয়ে যায়।
কিন্তু তার পর থেকে, ক্রমশই বিশ্বজুড়ে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বাড়তে থাকায় খাপছাড়া নামে চিহ্নিত করতে খুবই বেগ পেতে হচ্ছিল। এরপরই ঘূর্ণিঝড়ের আলাদাভাবে নামকরণের কথা ভাবেন বিশিষ্ট আবহাওয়াবিদ ক্লিমেন্ট লিন্ডলে রাগে।
বিশ শতকের দুনিয়া নতুন করে ঝড়ের নামকরণের পথ বেছে নিল। পশ্চিমী আবহাওয়াবিদরা একই সমুদ্রের বুকে বিভিন্ন ঘূর্ণিঝড়কে আলাদা আলাদা নামে ডাকতে শুরু করলেন। সেসব নাম অবশ্য পশ্চিমী মহিলাদের নাম অনুসারেই। মৌলিক কিছু নয়। ১৯৯৭ সালে হংকং থেকে প্রতিবাদ আসে। পশ্চিমী নামে তাঁরা তাঁদের স্থানীয় ঝড়ের নাম রাখবেন কেন? স্থানীয় ঝড়ের নাম স্থানীয়ই হবে।
প্রসঙ্গত, ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান বা বর্তমান বাংলাদেশের ওপর দিয়ে এক তুমুল ঝড় বয়ে যায় যাতে প্রায় ৫ লক্ষ মানুষ মারা যান। সেই ঝড়ের নামকরণ হয়েছিল ভোলা। ভয়াবহ সেই ঝড় কিন্তু স্থানীয় নাম দিয়েই স্মরণে রাখা হয়েছে।
২০০০ সালে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা ঝড়ের নামকরণের বিষয়ে একটা সমঝোতায় আসতে চায়। উত্তর ভারত মহাসাগরের ওপর ঘনিয়ে ওঠা ঝড়গুলোর জন্যই আগে নামের প্রস্তাব চেয়ে পাঠানো হয়। ভারত শুরুতেই নাম প্রস্তাব করতে চায়, কিন্তু মঞ্জুর হয়নি। দীর্ঘ ৪ বছর পর ভারতের প্রস্তাবিত নাম গ্রাহ্য হয়। ২০০৪ সালের সাইক্লোনের নাম হয় 'অনিল'।
এরপর বিশ্ব আবহাওয়া দফতর এশিয়ার কয়েকটি দেশের আবহাওয়া বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি স্থানীয় আবহাওয়া সংস্থা গঠন করে। শুরুতে তার সদস্য হয় বাংলাদেশ, ভারত, মালদ্বীপ, মায়ানমার, ওমান, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা এবং তাইল্যান্ড। ২০১৮ সালের পর থেকে ইরাক, ইরান, সৌদি আরব-সহ মধ্য প্রাচ্যের আরও ৫টি দেশকে সদস্য করে নেওয়া হয়। এখন সেই সংস্থার অধীনে ১৩টি দেশ মিলেই স্থানীয় ভূপ্রকৃতি সংক্রান্ত যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। নামকরণের কাজও এখন থেকেই হয়।
সামুদ্রিক ঝড়ের জন্য আগাম নামকরণ করা থাকে। তালিকা ফুরোলে আবার নতুন নাম অন্তর্ভুক্ত হয়। প্রতিবার ১৩টি দেশ ১৩টি করে নামের প্রস্তাব পাঠায়। সবমিলিয়ে নামের ভাণ্ডার ১৬৯টি। গতবছর সাইক্লোনের নাম যে 'আমফান' বাছা হয়েছিল, জানা যায় সেটা পুরনো তালিকার নাম। ব্যবহার না হওয়ায় এবার নতুন তালিকার অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সব দেশের দেওয়া নামই মনোনীত এবং নির্বাচিত হয়।
কেন সাইক্লোনের নাম দেওয়া জরুরি? আবহাওয়া বিশেষজ্ঞদের মতে, অনেকগুলো কারণ রয়েছে। তাঁরা জানাচ্ছেন, সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগসাধনের সহজ উপায় তো এটাই। মানুষকে সতর্ক করার ক্ষেত্রে অমুক সালের অমুক ঝড়ের মত না বলে একটা নাম দিয়ে সতর্কতার মাত্রা চিহ্নিত করা যায়। দ্বিতীয়ত, একই ঘূর্ণিঝড়প্রবণ তটে একাধিক ঝড় এলে তার নাম আলাদা থাকলে সুবিধে হয়। তাছাড়া, প্রযুক্তিগত শব্দ বা বৈজ্ঞানিক নামের বদলে ঝড়ের বিশেষ নামকরণের ফলে আবহাওয়াবিদদের ও কাজে সুবিধে হয়, এমনটাই জানাচ্ছেন বিশ্ব আবহাওয়া দফতরের আধিকারিকরা।
তবে ঝড়ের নামকরণ প্রস্তাবের ক্ষেত্রে কিছু শর্ত আছে। কোনও রকম ধর্মীয় বিতর্ক এবং লিঙ্গবৈষম্য এড়িয়ে এই নামকরণ করতে হবে। কারও ব্যক্তিগত মূল্যবোধে আঘাত হানতে পারে এমন নাম গ্রাহ্য হবে না। কঠিন, নিষ্ঠুর বা অপশব্দ প্রয়োগ করা চলবে না। কোনও রাজনীতিবিদ কিংবা বিতর্কিত ব্যক্তিত্বের নামও এক্ষেত্রে গ্রাহ্য হবে না। নামের ধরন হবে ছিমছাম, হালকা এবং মিষ্টি। সর্বাধিক আট অক্ষরের মধ্যেই নাম সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। সেইসঙ্গে প্রস্তাবিত নাম অক্ষর ভেঙে সঠিক উচ্চারণ সহ পাঠাতে হয়।
উপরোক্ত শর্তগুলো মেনেই ১৩টি দেশের আবহাওয়া প্রতিনিধিরা নাম প্রস্তাব করেন। ভারতের তরফে সম্প্রতি ১৩টা নাম গেছিল। তার মধ্যে ছিল - গতি, তেজ, মুরাসু, আগ, প্রবাহ প্রভৃতি। কিছু নাম দেশের জনগণের থেকেও চাওয়া হয়েছিল। সেগুলো তালিকাভুক্ত করে এএমডি দফতরে পাঠানো হয়। সেখান থেকে মনোনীত হলে চূড়ান্ত নাম ঘোষণা করা হয়।