বিরল কালো বাঘ।
শেষ আপডেট: 29th January 2025 16:03
দ্য ওয়াল ব্যুরো: এক যে ছিল বাঘ /তার গায়ে ডোরাকাটা দাগ /লক্ষ্মীসোনা ছেলে এক /কেউ বকে না কেউ মারে না একটুও নেই রাগ!
ছেলেভুলোনোর গানে হোক, বা রবিঠাকুরের ছড়ায়, বাঘ বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে হলদে-কালো ডোরাকাটা এক রাজকীয় চেহারা। তবে এই ডোরার বাহার যতই বাঘের নিজস্ব হোক না কেন, বৈচিত্র্যও রয়েছে। কালো চামড়ার উপর কালো ডোরা (Black Tiger)। এমনটাও দেখা যায় ব্যাঘ্রকুলের ‘স্পেশ্যাল চাইল্ড’দের গায়ে। সহজ কথায় তাদের নাম: ব্ল্যাক টাইগার। বাড়ি: ওড়িশার সিমলিপাল টাইগার রিজার্ভ। স্টেটাস: বিরল প্রাণী।
সম্প্রতি এই বিরল কালো বাঘেদের কেন্দ্র করেই বিশ্বের প্রথম ব্ল্যাক টাইগার সাফারি চালু করা হবে সিমলিপালে। এই বিরল ও রাজসিক কালো বাঘের ভাল নাম মেলানিস্টিক টাইগার। কেবহল ওড়িশাতেই পাওয়া যায় এদের। চলতি বছরের অক্টোবর মাসের মধ্যেই সাফারিটি চালু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
যা ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গের সীমানার কাছাকাছি অবস্থিত ওডিশার ময়ূরভঞ্জ জেলায় প্রায় ১০ হাজার বর্গমাইল এলাকাজুড়ে রয়েছে ময়ূরভঞ্জ এলিফ্যান্ট রিজার্ভ। তার অন্দরেই অবস্থিত সিমলিপাল টাইগার রিজার্ভ, হাদাগড় ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি ও কুলডিহা ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি। রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার, এশিয়ান হাতি, বাইসন ও চৌসিঙ্গার (চার শিংওয়ালা হরিণ) পাশাপাশি কালো বাঘেদেরও খোঁজ মেলে এখানে।
মেলানিজম হলো একধরনের জিনগত বৈশিষ্ট্য, যেখানে শরীরে মেলানিন নামক পিগমেন্টের মাত্রা বেশি থাকায় পশুর গায়ের রঙ স্বাভাবিকের তুলনায় গাঢ় বা কালো দেখায়। সিমলিপালের বেঙ্গল টাইগারদের মধ্যে এমনই কিছু ব্যতিক্রমী বাঘ আছে, যাদের দেহে হলুদ-কালো ডোরার পরিবর্তে কালো ছাপ বেশি থাকে। তবে এদের চামড়া সম্পূর্ণ কালো নয়, তাই এগুলোকে 'সিউডো-মেলানিস্টিক' টাইগারও বলা হয়।
২০২২ সালের অল ইন্ডিয়া টাইগার এস্টিমেশনের তথ্য অনুযায়ী, সিমলিপালে ১৬টি বাঘ পাওয়া গেছে, যার মধ্যে ১০টি মেলানিস্টিক টাইগার রয়েছে। রাজ্য সরকারের সাম্প্রতিকতম হিসেব অনুযায়ী, এই সংখ্যাটি আরও বেশি হতে পারে।
ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেস (NCBS), বেঙ্গালুরুর গবেষণা অনুসারে Taqpep (Transmembrane Aminopeptidase Q) নামে একটি বিশেষ জিনগত পরিবর্তনের কারণে টাইগারের গায়ের কালো ডোরাগুলি বেশি ছড়িয়ে পড়ে, ফলে কালো রংটাই বেশি দেখা যায়।
সিমলিপালের এই ধরনের কালো বাঘদের বংশগত বৈশিষ্ট্য খুবই সীমিত, কারণ তারা একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী থেকে প্রজনন ঘটানোর ফলে সংখ্যায় বেড়েছে।
সম্প্রতি ওড়িশার সিমিলিপাল ব্যাঘ্র প্রকল্পে চোরাশিকারিদের হানায় প্রাণ হারায় একটি বিরল কালো বাঘ। দু'বছরের মধ্যে এটি সিমিলিপালে দ্বিতীয় কালো বাঘের মৃত্যুর ঘটনা। বন দফতর জানিয়েছে, বাঘটিকে হত্যা করা হয়েছে তার চামড়া, নখ, দাঁত এবং অন্যান্য মূল্যবান দেহাংশের জন্য।
এই পরিস্থিতিতে ব্ল্যাক টাইগার সাফারির পরিকল্পনা নিয়েছে ওড়িশা। পরিকল্পনাটি ন্যাশনাল টাইগার কনজারভেশন অথরিটি (NTCA)-র টেকনিক্যাল কমিটির প্রাথমিক অনুমোদন পেয়েছে। প্রাথমিক ভাবে ধানবাদ-বালাসোর সংলগ্ন ২০০ হেক্টর জমি চিহ্নিত করা হয়েছে এই উদ্দেশ্যে।
বন দফতর সূত্রের খবর, প্রাথমিক পর্যায়ে নন্দনকানন চিড়িয়াখানা (ভুবনেশ্বর) থেকে তিনটি মেলানিস্টিক টাইগার আনা হবে।
বিরল কালো বাঘদের সংরক্ষণের পাশাপাশি তাদের সম্পর্কে গবেষণা ও সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ হিসেবেই প্রাথমিক ভাবে এই পরিকল্পনা। সিমলিপালের বিশাল এলাকা ও ঘন অরণ্যের কারণে এমনিতেই বাঘ দেখা কঠিন, সেখানে কালো বাঘ তো আরওই বিরল। তাই দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করতে নতুন সাফারি চালু করা হচ্ছে।
এই প্রকল্প ওড়িশাকে বিশ্বে প্রথম ব্ল্যাক টাইগার সাফারির হোস্ট হিসেবে পরিচিতি দেবে। এটি রাজ্যের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের অঙ্গীকারেরও প্রতীক হবে। সব মিলিয়ে, ওড়িশার এই উদ্যোগ শুধু পর্যটনের জন্যই নয়, এটি এক অনন্য সংরক্ষণ প্রকল্পও হয়ে উঠতে চলেছে, যা বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করবে।
এই সাফারি সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে এটি বিশ্বের প্রথম মেলানিস্টিক টাইগার সংরক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। বিশ্বের নানা প্রান্তের পরিবেশবিদ, গবেষক এবং বন্যপ্রাণীপ্রেমীদের জন্য এটি একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ হবে।