শেষ আপডেট: 12th March 2025 16:23
দ্য ওয়াল ব্যুরো: পাকিস্তানের 'পরাধীনতামুক্ত স্বাধীন' বালুচিস্তান চাই। ইংরেজদের হাত থেকে ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই এই এক দাবিতে লড়ে যাচ্ছে বালুচিস্তানের লড়াকু যোদ্ধারা। যার মূলে রয়েছে বালুচ সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে পাকিস্তানের জনক মহম্মদ আলি জিন্নার বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস। সেই রক্তাক্ত ও বিনিদ্র লড়াইয়ের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে দেশের প্রাক্তন সেনাশাসক পারভেজ মোশারফের সেনা নামিয়ে বালুচ-নিকেশ অভিযান। মোশারফের সেই স্বপ্ন তো পূরণ হয়ইনি, উপরন্তু আগুন যেন দ্বিগুণ বেগে লেলিহান হয়ে দেখা দেয় এই অঞ্চলে।
বালুচ যোদ্ধাদের প্রতি বরাবরই ভারত সরকার সহমর্মী। বালুচিস্তানের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে অনেকাংশে মিল রয়েছে বাংলাদেশেরও। যেন আরেকটি বাংলাদেশ মুখ গুঁজে রয়েছে পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী এই অঞ্চলে। অতীতের কংগ্রেস সরকার সহ বর্তমানের বিজেপির সরকার প্রথম থেকেই বালুচিস্তানের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচ্ছন্ন সমর্থন জুগিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকার বালুচিস্তানে মানবাধিকার ভঙ্গ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আগেই। ২০১৬ সালে লালকেল্লা থেকে ভাষণে মোদী বালুচিস্তান ও গিলগিটের মানুষের প্রতি সহানুভূতি সমর্থন প্রকাশ করেছিলেন। বালুচিস্তানের মানুষও তাঁদের লড়াইয়ে ভারতের সমর্থন চেয়ে এসেছেন বরাবর।
নেহরু ও জিন্নার ভুল
কিছু ইতিহাসবিদের মতে, দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এবং অন্য কংগ্রেস নেতাদের ভুলে পাকিস্তান সেনা নামিয়ে জোরজবরদস্তি বালুচিস্তান অধিগ্রহণ করে নেয়। যার অন্যতম নায়ক ছিলেন তৎকালীন পাক প্রেসিডেন্ট মহম্মদ আলি জিন্না। ভারতভাগের ইতিহাস বলে, স্বাধীনতা অর্জনের পরে জম্মু-কাশ্মীরের মতোই বালুচিস্তানের তৎকালীন শাসকও ভারত-পাকিস্তান কোনও দেশেই যোগ না দিয়ে স্বাধীন থাকার ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু, পাকিস্তানি সেনা ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে বালুচিস্তান দখলে অভিযানে নামে।
পাকিস্তানের মূল ভয় ছিল জম্মু-কাশ্মীরের মতো বালুচিস্তানকেও অন্তর্ভুক্ত করতে পারে ভারত। কারণ, ব্রিটিশরা দেশ ছাড়ার আগে বালুচদের সবথেকে বড় নেতা বা রাজা খুদাদদ খান ওরফে কালাতের খান-এর সঙ্গে চুক্তি করেছিল। তাতে বালুচিস্তানকে স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। পাকিস্তান প্রথমে রাজি হলেও পরে স্বাধীন বালুচিস্তানকে অস্বীকার করে। এদিকে জওহরলাল নেহরুও বালুচিস্তান অধিগ্রহণে রাজি ছিলেন না। এরমধ্যে খান পাকিস্তানের পক্ষে থাকলেও তাঁর অঞ্চলবাসীর বিরোধিতায় তিনি পাকিস্তানে ঢুকতে পারেননি। কিন্তু ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান বালুচিস্তান আক্রমণ করে খানকে গ্রেফতার করে এবং জোর করে অধিগ্রহণপত্রে সই করিয়ে নেয়।
আন্দোলনের কারণ ও জন্ম
বালুচিস্তান হল পাকিস্তানের সবথেকে বড় প্রদেশ। কিন্তু, প্রথম থেকে পাকিস্তানের চালিকাশক্তি হল পাক পাঞ্জাবের নেতৃত্ব। পাকিস্তানের মোট ভৌগোলিক জমির ৪৪ শতাংশই হল বালুচিস্তানে। বালুচিস্তানকে ঘিরে রয়েছে ইরান, আফগানিস্তান এবং আরব সাগর। সেই হিসেবে কিছু আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞের মতে, নেহরু যদি বালুচিস্তান অধিগ্রহণ না করলেও তাদের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিতেন তাতে পাকিস্তানের আয়তন অনেক কমে যেত। এবং তারা দুর্বল হয়ে থাকত। এর মূল কারণ হল বালুচিস্তানের লোকসংখ্যা অত্যন্ত কম। এখানে প্রধানত বালুচ, পাশতুন এবং অন্যান্য উপজাতীয় সম্প্রদায়ের বসবাস। যাদের পৃথক ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য-পরম্পরা ও নিজস্ব পরিচিতি রয়েছে। তারা কিছুতেই পাকিস্তানকে নিজের দেশ কিংবা নিজেদের পাকিস্তানি বলে স্বীকার করে না।
খনিজ সম্পদে ভরপুর পাকিস্তান সরকার এখানকার সম্পদ ব্যবহার করলেও এই এলাকার উন্নয়নে নজর দেয় না। বেকারি-দারিদ্র্য-অপুষ্টি বালুচদের নিত্যসঙ্গী। এমনকী কেন্দ্রীয় বাজেটেও এই এলাকার জন্য সবথেকে কম বরাদ্দ করা হয়ে থাকে। সে কারণেই বিভিন্ন সময়ে গড়ে ওঠে বালুচ লিবারেশন আর্মি, বালুচ লিবারেশন ফ্রন্ট ও মজিদ ব্রিগেডের মতো সংগঠন, যারা সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিকতম লড়াইটি শুরু হয়েছে ২০০৬ সালে বালুচ আদিবাসী নেতা নবাব আকবর খান বুগতিকে পাক সেনাশাসক পারভেজ মোশারফের বাহিনী হত্যা করার পর। এর আগে ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের সময়েও একইভাবে স্বাধীনতার দাবিতে জেগে উঠেছিল সমগ্র বালুচিস্তান।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল অনিল আঠাওয়ালে ১৯৭১ সালে একটি নিবন্ধে লিখেছিলেন, বাংলাদেশ যুদ্ধ যখন চরমে, তখন বালুচিস্তানের স্বাধীনতার দাবিতেও কোয়েট্টায় মিছিল বেরিয়েছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার নামে জয়ধ্বনি দেওয়া হয়েছিল সেই মিছিল থেকে। কিন্তু, বাংলাদেশের মতোই বালুচিস্তানের সেই জাগরণকে গুলিবৃষ্টিতে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিলেন অত্যাচারী পাক সেনা অফিসার জেনারেল টিক্কা খান। যাঁকে এই কাজের জন্য ছদ্মনাম দেওয়া হয়েছিল বালুচিস্তানের নরঘাতক বলে।
কে নবাব আকবর খান বুগতি?
বালুচিস্তানের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে আকবর খান অত্যন্ত জনপ্রিয় এক ব্যক্তিত্ব। ৬ ফুট লম্বা। মুখজোড়া পাকানো গোঁফ। শক্ত চোয়াল এবং চাঁচাছোলা ভাষায় পাক সরকারের বিরুদ্ধে জনগর্জন তোলা বুগতিকে হত্যা করে মোশারফ বাহিনী। আকবর খান ছিলেন নবাব মেহরাব খান বুগতির ছেলে। বুগতি বংশের প্রধান ছিলেন। ২০০৫ সালে আকবর খান পাক সরকারকে ১৫ দফা দাবিপত্র পাঠান। যাতে অবাধ স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানান। বালুচিস্তানের সমস্ত খনিজ সম্পদের উপর বালুচদের জন্মসূত্র অধিকার এবং এই এলাকায় পাক সেনাবাহিনী ঘাঁটি তুলে ফেলার দাবিও জানান তিনি। তখনই পাকিস্তান সেনা আক্রমণ করে বালুচিস্তান। শুরু হয় ভয়ঙ্কর যুদ্ধ। শেষমেশ নবাব আকবর খান বুগতিকে পরিকল্পিতভাবে খুন করে।
বালুচিস্তান ইস্যুতে মোদী সরকার কী করতে পারে?
এই অবস্থায় একটি বিরাট প্রশ্নচিহ্ন দেখা দিয়েছে, আর তা হল যদি মোদী সরকার বালুচ নাগরিকদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়, তাহলে কি বিরোধীদের পাশে পাবে? কারণ কোনও সরকারকে এ ধরনের পররাষ্ট্রীয় বিষয়ে আগে দেশের বিরোধী দলগুলির সঙ্গে ঐকমত্য গড়ে তুলতে হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যে সেনা পাঠানোর আগে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকেও দেশের বিরোধী দলগুলির মতামত নিতে হয়েছিল। সেই সময় বিরোধী নেতা অটলবিহারী বাজপেয়ী সহ তাবড় বিরোধী দলনেতারা ইন্দিরার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মোদী সরকার বালুচিস্তানের পাশে দাঁড়াতে চাইলে ইন্ডিয়া জোট শরিক দলগুলি কী ভূমিকা নেবে?