শেষ আপডেট: 11th April 2025 08:49
দ্য ওয়াল ব্যুরো: ভারতের ইতিহাসে এক অমোচনীয় ক্ষত হয়ে রয়েছে ২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বরের বিভীষিকাময় রাত। মুম্বইয়ের বিভিন্ন অংশে ধারাবাহিক সন্ত্রাসী হামলায় প্রাণ হারান ১৬৬ জন, আহত হন অন্তত ২৩৮ জন। এই দুঃসহ ঘটনার ঠিক ১৬ বছর পর, ২৬/১১-র মূল ষড়যন্ত্রকারী তাহাউর হুসেন রানাকে ভারতে প্রত্যর্পণ করা হয়েছে, যা একদিকে যেমন ন্যায়বিচারের পথে অগ্রসর হওয়ার দৃষ্টান্ত, তেমনই উসকে দিয়েছে সেই ভয়ঙ্কর রাতের স্মৃতিও।
সেই স্মৃতির মধ্যেই ফুটে ওঠে এক নার্সের কথা। আতঙ্ক আর মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও তিনি রক্ষা করেছিলেন ২০ জন গর্ভবতী তরুণীকে। মুম্বইয়ের কামা হাসপাতালে কর্মরত নার্স অঞ্জলি কুলঠের সাহসিকতাকে কুর্নিশ করেছে গোটা দেশ।
২৬ নভেম্বর রাত প্রায় ৯.৩০টা। সিএসটি স্টেশনে হামলার পরে খবর আসে, জঙ্গিরা কামা হাসপাতালের দিকেই আসছে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই হাসপাতালের পিছনের গলি থেকে গুলির শব্দ শোনা যায়। নার্স অঞ্জলি জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখেন, দুই জঙ্গি ছুটে আসছে, পিছন থেকে পুলিশ গুলি চালাচ্ছে। মুহূর্তের মধ্যে জঙ্গিরা হাসপাতালের নিচু গেট টপকে ভেতরে ঢুকে পড়ে।
প্রথমেই তাঁরা গুলি চালিয়ে হত্যা করে দুই নিরাপত্তারক্ষীকে। নার্সরা যখন জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাঁদের লক্ষ্য করেও গুলি চালানো হয়। এক কর্মী আহত হন, দ্রুত তাঁর চিকিৎসা করাতে নিয়ে যান অঞ্জলি কুলঠে। খবর দেওয়া হয় যে জঙ্গিরা হাসপাতাল চত্বরে ঢুকে পড়েছে।
সেই পরিস্থিতিতেও কর্তব্যবোধে অটল থেকে দ্রুত হাসপাতালের মূল ওয়ার্ডের দরজা বন্ধ করেন অঞ্জলি। ২০ জন গর্ভবতীকে একটি ছোট্ট ১০x১০ প্যান্ট্রি ঘরে নিয়ে যান। আলো নিভিয়ে, ফোন বন্ধ করে, একেবারে নিঃশব্দে তাঁরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেই ঘরে অপেক্ষা করেন।
এই সময়েই এক তরুণী প্রসব যন্ত্রণা অনুভব করতে থাকেন। আতঙ্কে কেউ সাহায্য করতে চাননি তাঁকে। ততক্ষণে গোটা হাসপাতাল গুলির আওয়াজে কেঁপে উঠতে থাকে। এমন অবস্থায় অঞ্জলি নিজেই একটা করে ধাপ পেরিয়ে, দেওয়াল ঘেঁষে তাঁকে সিঁড়ি দিয়ে নিয়ে যান প্রসূতি ওয়ার্ডে।
সেই রাতের অন্ধকার পেরিয়ে সকাল হওয়ার পরে ওই তরুণী এক কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। মেয়েটির নাম রাখা হয় ‘গুলি’—সেই ভয়ঙ্কর রাতের স্মৃতিতে।
সেই রাতে হাসপাতালে পাঁচ ঘণ্টা ধরে চলেছিল গুলির লড়াই। নিহত হয়েছিলেন দুই নিরাপত্তারক্ষী ও আরও এক স্বাস্থ্যকর্মী।
অঞ্জলি বলেন, 'আজও সেই রাত ভুলতে পারিনি। যেভাবে ওরা গ্রেনেড ছুড়েছিল, নির্বিচারে গুলি চালিয়েছিল, মানুষ খুন করেছিল, আমরা কেউই ভুলতে পারি না। সেই রাত ছিল গোটা দেশের শোক আর সন্ত্রাসের রাত।'
২০০৮-এর সেই তিন দিনের হামলায় লক্ষ ছিল হোটেল, ট্রেন স্টেশন, ইহুদি উপাসনালয়-সহ একাধিক জনবহুল জায়গা। দশ জঙ্গির মধ্যে একমাত্র আজমল কাসব জীবিত ধরা পড়ে, যাকে ২০১২ সালের ২১ নভেম্বর ফাঁসি দেওয়া হয়।
ভারত বারবার দাবি করে এসেছে, এই হামলার মূল কারিগররা পাকিস্তানভিত্তিক এবং তারা পাকিস্তানি নিরাপত্তা সংস্থার মদতেই এই হামলা চালিয়েছিল।
এই হামলার অন্যতম মূলচক্রী তাহাউর হুসেন রানাকে বৃহস্পতিবারই আমেরিকা থেকে ভারতে প্রত্যর্পণ করা হয়েছে। ভারতীয় গোয়েন্দাদের মতে, পাকিস্তানি-মার্কিন নাগরিক রানা জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈবার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং প্রধান অভিযুক্ত ডেভিড হেডলিকে আর্থিক ও লজিস্টিক সাহায্য করে ছিলেন। হেডলি নিজেই পরে স্বীকার করেন যে রানার সহায়তাতেই হামলার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়েছিল।
রানার বিরুদ্ধে ভারতে ফৌজদারি ষড়যন্ত্র, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা, হত্যা, জালিয়াতি এবং ইউএপিএ আইনে অভিযোগ আনা হয়েছে।
তাহাউর রানার প্রত্যর্পণের সময়ে সেই রাতের সাহসিকতা, বিশেষ করে নার্স অঞ্জলি কুলঠের মতো মানুষদের অবদান, দেশবাসীকে আরও একবার মনে করিয়ে দেয়, মানবতা ও সাহসের সমন্বয় ঘটলে তা ঠিক কতটা শক্তিশালী হতে পারে। চারপাশে শুধু মৃত্যু আর ভয়ের মাঝেও জীবনের ফসল ফলতে পারে।