শেষ আপডেট: 12th November 2024 14:20
দ্য ওয়াল ব্যুরো: হাঁস ছিল, সজারুও (ব্যাকরণ মানি না),/ হয়ে গেল, 'হাঁসজারু' কেমনে তা জানি না। সুকুমার রায়ের খিচুড়ি কবিতার মতোই দিল্লির দূষণ সমস্যার কবর খুঁড়ে বেরল বিচিত্র এক রহস্য! কথা ছিল, এক নতুন 'সবুজ' বিপ্লব হবে। হয়ে গেল রাজধানীকে বিষাক্ত করে তোলার প্রধান কেন্দ্রস্থল। কীভাবে? একবার দেখে নেওয়া যাক সেই গুপ্তরহস্য কোথায় লুকিয়ে রয়েছে?
বছরের পর বছর ধরে ঘুম থেকে উঠেই দিল্লিবাসী দেখতে পান ট্রাকের পর ট্রাক ভর্তি গরম ছাই-আবর্জনা খেলার মাঠ অথবা স্কুলের পাশে ফেলে দিয়ে যাচ্ছে। বাসিন্দারা চোখ জ্বালা, দীর্ঘ মাথা ধরা, কাশিতে ভুগছেন। এর সঙ্গে জুড়ে রয়েছে আবর্জনা পোড়ানো। জমা হওয়া আবর্জনার পাহাড় ২০০ ফুট উচ্চতায় দাঁড়িয়ে। দূর থেকে সেই আবর্জনার চুড়ো দেখা যায়। ২০ তলা বাড়ির সমান সেই আবর্জনা অনেক সময় ভেঙে পড়ে কিংবা একবার আগুন ধরে গেলে বেশ কয়েকদিন ধরে তা থেকে বিষাক্ত ধোঁয়া বেরতে থাকে।
এই অবস্থায় দিল্লি সরকার পরিবেশ বান্ধব একটি পরিকল্পনা নিয়েছিল। আবর্জনা থেকে বিদ্যুৎ তৈরির প্রকল্প। বছরের পর বছর যাবৎ আবর্জনার দূষণ ও রাজধানীর বিদ্যুৎ সমস্যার হাল ফেরাতে এটা ছিল সাধু উদ্যোগ। কিন্তু, গত পাঁচবছর ধরে চলা একটি সমীক্ষায় মার্কিন সংবাদপত্র নিউইয়র্ক টাইমস তুলে ধরেছে এক বিপরীত বাস্তব। দিল্লির ওখলার এই আবর্জনা থেকে বিদ্যুৎ তৈরির কারখানাই লক্ষ লক্ষ বাসিন্দার ধীরমৃত্যুর পথ সুনিশ্চিত করে চলেছে। এক ঢিলে দুই পাখি মারতে যাওয়া এই কারখানা থেকে নির্গত উচ্চ-ক্ষতিকারক বিষাক্ত ধোঁয়া দিনের পর দিন ধরে বাসিন্দাদের স্বাস্থ্যকে তিলতিল করে ক্ষয় করে দিচ্ছে।
পাঁচ বছর ধরে নিউইয়র্ক টাইমস এই এলাকার বাতাস ও মাটির নমুনা পরীক্ষা করে দেখেছে, বিষাক্ত ধোঁয়া এবং কারখানার ছাইয়ে অন্ততপক্ষে ১০ লক্ষ লোক রোজ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বাসিন্দারা একে গণবিষাক্ত করে তোলা বলে মন্তব্য করেন। পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে, এই ধোঁয়া থেকে সিসা, আর্সেনিক এবং অন্যান্য বিষাক্ত উপাদান মিলেছে। যা বৃষ্টির মাধ্যমে মাটিতে এসে মিশছে এবং পরিবেশকে দূষিত করে তুলছে।
পত্রিকার দাবি, এই বিষাক্ত ছাই নিয়ে যাওয়া ট্রাকগুলি বছরের পর বছর ধরে অবৈধভাবে বসত এলাকায় তা ফেলে দিয়ে যাচ্ছে। তা হতে পারে স্কুলের ধারে কিংবা খেলার মাঠের পাশে অথবা বাড়ি-পার্কের গায়ে। এইসব ছাইয়েও রয়েছে বিষাক্ত নানান ধাতু থেকে অন্য উপাদান। যা মানবদেহে সহনশীলতার থেকে অনেক বেশি।
কয়েক জায়গা খুঁড়ে দেখা গিয়েছে যে এই বিষাক্ত ছাইয়ের উপরেই রয়েছে স্কুলের জমি কিংবা কোনও পার্ক। যেখানে শিশুরা ছোটাছুটি করে। শিশুরা ছাইয়ের উপরেই খেলা করছে। এবং আরও ট্রাক এসে ছাই ফেলে চলে যাচ্ছে। বাতাস এবং মাটিতে যে পরিমাণ বিষাক্ত রাসায়নিক এবং ভারী ধাতুকণা মিশছে তাতে শিশুজন্মের ক্ষতি, ক্যানসার এবং অন্যান্য মারণ অসুখ হতে পারে বলে দাবি নিউইয়র্ক টাইমসের।
স্থানীয় এলাকার ডাক্তার ও বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, মায়েদের অকাল গর্ভপাত, ত্বক কুঁচকে আসা এবং শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নির্গত ধোঁয়া এবং ছাই দুটোতেই বিষাক্ত উপাদান মিলেছে। দেশের সরকারও এই বিপজ্জনক তথ্যের কথা জানে।
সরকারের অভ্যন্তরীণ রিপোর্টে রয়েছে, এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে এত বেশি ডায়োক্সিন বেরোয়, যা আইনত পরিমাণের চেয়ে ১০ গুণ অতিরিক্ত। তা সত্ত্বেও দেশের এক ধনকুবের গোষ্ঠীর আয়ত্তে থাকা এই কারখানা ২০১১ সালে রাষ্ট্রসঙ্ঘের শংসা জোগাড় করে। জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার না করে আবর্জনা থেকে বিদ্যুৎ তৈরি এই প্রকল্প আন্তর্জাতিক সংগঠনের প্রশংসা পায়। কিন্তু, এই কারখানার অনেক প্রাক্তন এবং বর্তমান কর্মী সমীক্ষাকারীদের জানিয়েছেন, এখানে পরিবেশ বান্ধব কোনও ব্যবস্থাই নেই।
২০২০ সালে মৃত্যুর আগে দ্য টাইমস পত্রিকাকে এই কারখানার প্রাক্তন ম্যানেজার রাকেশকুমার আগরওয়াল বলেছিলেন, কারখানাকে কোনওদিন নিয়ন্ত্রণ করা হয়নি এবং সরকার সবকিছু জানে। ন্যূনতম নিরাপত্তা ব্যবস্থা খরচ বাঁচানোর কথা ভেবে নেওয়া হয় না। দূষিত বর্জ্য পরিশোধন না করেই তা পরিবেশে ছাড়া হয়। যার ফলে বিপজ্জনক রাসায়নিক দিল্লিতে অবাধে ছড়িয়ে পড়ছে।
২০১৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, কারখানা সংলগ্ন এলাকার বাতাসে ১৫০ রকমের বাতাস ও মাটি দূষণের উপাদান রয়েছে। দিল্লির আইআইটি এবং জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা এই নমুনা পরীক্ষা করে এই তথ্য জানিয়েছেন। কারখানা চালু হওয়ার পর থেকে এই অঞ্চলের আশপাশে বাস করা বহু মানুষের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। ত্বকের ঔজ্জ্বল্য কমে যায়। ঘর, বারান্দা, পার্কিং করা গাড়ি, খেলার মাঠ রোজ দূষিত ছাইয়ের আস্তরণে ঢেকে যায়। জনজীবনকে এত কিছু বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া টিমারপুর-ওখলা ওয়েস্ট টু এনার্জি প্ল্যান্ট যা দিল্লির বুকের উপর বসে রয়েছে, তা বহালে চলছে। দিনে অন্তত ৩ হাজার টন আবর্জনা পুড়িয়ে সামান্যতম বিদ্যুৎ উৎপাদন করে চলেছে।