শেষ আপডেট: 30th January 2025 11:04
দ্য ওয়াল ব্যুরো: বছর ছয়েকের ছোট্ট সৌম্য (Guillain Barre Survivor) ঠিকমতো পেনসিলই ধরতে চাইছিল না। এদিকে স্কুলের হোমওয়ার্ক বাকি। ছেলের দুষ্টুমিতে দু’ঘা বসিয়েই দিয়েছিলেন মা। যাও বা সে ধরল পেনসিল, লেখা আর ঠিক হয় না, বারবারই এঁকেবেঁকে যায়। পেশায় স্কুল শিক্ষিকা মা বারবারই মুছে দিচ্ছিলেন সে লেখা, বলছিলেন, ঠিক করে লিখতে।
পুণের বাসিন্দা সরলা শালুঙ্কে তখন দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেননি, সৌম্য মোটেই দুষ্টুমি করছে না, ছেলের আঙুল আসলে অসাড় হয়ে গিয়েছে। ঠিকমতো লেখার সাধ্যই নেই তার। কারণ তার শরীরে বাসা বেঁধেছে গুলেন বারি সিনড্রোম!
বিরল অটোইমিউন নিউরোলজিক্যাল এই রোগে শরীরের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা নিজেই স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রমণ করে। এর ফলে যে সব স্নায়ু হাত-পায়ের নড়াচড়া নিয়ন্ত্রণ করে, সেগুলি অসাড় হতে শুরু করে। এটিই এই অসুখের প্রাথমিকতম লক্ষণ। যার কিছুই জানা ছিল না সরলার। তাই প্রাথমিক ভাবে অতটা গুরুত্বও দেননি তিনি।
সরলা জানান, পেনসিল ধরতে না পারার পরে, একসময়ে সে বিছানা থেকে উঠতেই পারছিল না, নিজে টয়লেটেও যেতে পারছিল না। ছোট ভাইয়ের সঙ্গে খেলতে গিয়ে পড়ে গেলে, তার পরেও আর উঠতে পারছিল না।
এটা ছিল জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি। তার আগের সপ্তাহ থেকে জ্বর আর ডায়রিয়ায় ভুগছিল সৌম্য। সে সময়ে অবশ্য গোটা পরিবারেরই পেট খারাপ হয়েছিল বাইরের খাবার থেকে। কিন্তু সৌম্যর জ্বর অনেকটাই বেশি হয়েছিল। জ্বর কমে যাওয়ার প্রায় এক সপ্তাহ পরে শুরু হয় পায়ে ব্যথা। খেলতে চাইছিল না সে, স্কুলেও যেতে চাইছিল না।
এর পরেই পরিস্থিতি ধীরে ধীরে খারাপ হতে থাকলে, সরলা ও তাঁর স্বামী সুনীল সৌম্যকে নিয়ে যান স্থানীয় হাসপাতালে। সেখানে তাকে ভর্তি করে কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা করেন ডাক্তাররা। তার পরে তাকে পাঠানো হয় পুণের বড় হাসপাতালে। সেখানেই এমআরআই এবং নার্ভ কন্ডাকশন ভেলোসিটি টেস্ট করার পরে চিকিৎসকরা জানান, সৌম্য গুলেন বারিতে আক্রান্ত।
কোনও ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের সংক্রমণের পরে, শরীরের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করার পরিবর্তে ভুল করে শরীরের ভিতরের স্নায়ুগুলোকে আক্রমণ করে। এর মূল কারণ হল, ক্যাম্পাইলোব্যাক্টার নামক একটি জীবাণু, যা দূষিত খাবার ও পানীয়র মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে। প্রাথমিক ভাবে ডায়রিয়া হয়। তার পরেই গুলেন বারি।
চিকিৎসকরা জানান, গুলেন বারির রোগীরা প্রথমে হাতে-পায়ে দুর্বলতা অনুভব করে, পরে তা ধীরে ধীরে সারা শরীরে ও শ্বাস-প্রশ্বাসের পেশিগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে। ফলে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। সৌম্যরও তাই হয়েছিল এক সময়ে। সরলা বলেন, আইসিইউ-এর বেডে নিথর হয়ে শুয়ে থাকত ছেলে, হাত-পা নাড়াতে পারত না। এমনকি গিলতে বা কথা বলতেও পারত না। একসময় ও শ্বাসও নিতে পারছিল না।
এটাই গুলেন বারির সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক। শ্বাস-প্রশ্বাসের পেশিগুলোর ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়তে পড়তে যখন ডায়াফ্রামও (শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণকারী প্রধান পেশি) দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন রোগী ঠিকমতো শ্বাস নিতে পারে না। ফুসফুস থেকে কফ বের করতেও কষ্ট হয়, যা নিউমোনিয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।
এই পর্যায়ে পৌঁছনোর পরে সৌম্যকে ভেন্টিলেটর সাপোর্ট দিতে হয়। তার মুখ দিয়ে একটি টিউব ঢুকিয়ে সরাসরি ফুসফুসে অক্সিজেন পৌঁছনো হয়। একসময়ে তাকে IV-IG (ইন্ট্রাভেনাস ইমিউনোগ্লোবুলিন) ইঞ্জেকশন দেওয়া হয় এবং এর পরেই ধীরে ধীরে সুস্থ হতে শুরু করে সে।
পরিবার সূত্রের খবর, এখন সৌম্যর শারীরিক অবস্থা অনেকটাই উন্নত। সে আবার কথা বলতে পারছে এবং নিজের হাতে গ্লাস ধরে জল খেতেও পারছে।
সরলার কথায়, ‘১২ দিন পর আমার ছেলেটা কথা বলেছে, ওর মুখে হাসি ফিরে এসেছে। ডাক্তাররা বলেছেন, কিছুদিন ওর ফিজিওথেরাপি করাতে হবে, তার পরেই ও হেঁটে চলে বেড়াতে পারবে।’
চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, গুলেন বারি অসুখ যে কোনও বয়সেই হতে পারে। এটি এমন একটি রোগ, যেখানে বেশিরভাগ রোগী স্বাভাবিকভাবেই সুস্থ হয়ে ওঠে, তবে জটিলতা তৈরি হলে মৃত্যুও হতে পারে। কারণ রোগীর অটোনমিক নার্ভাস সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হলে, ব্লাড প্রেশার ওঠানামা করবে, হৃদস্পন্দন অনিয়মিত হবে। এর ফলে মৃত্যুও ঘটতে পারে।
রোগীদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ৩-৬ সপ্তাহের মধ্যে উন্নতি দেখা যায়, তবে কিছু ক্ষেত্রে পুরোপুরি সুস্থ হতে এক বছর পর্যন্ত লেগে যেতে পারে।