তাইবা আফরোজ
শেষ আপডেট: 12th March 2025 16:01
দ্য ওয়াল ব্যুরো: ছাপরার ব্যস্তসমস্ত রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল তাইবা। তাইবা আফরোজ৷ বাচ্চা মেয়ে। সবেতে কৌতূহল, সবকিছুতে জিজ্ঞাসা।
আশপাশ দিয়ে হুশহাশ বেরিয়ে যাচ্ছে চার চাকা, দু'চাকা। সেই দেখে তাইবার প্রশ্ন ছিল খুব সরল: ‘আব্বু, এই এদের যন্ত্রপাতি কীভাবে কাজ করে? আমিও গাড়ি চালাতে চাই।’
সেদিনের প্রশ্নকে ছেলেমানুষী ভেবে এড়িয়ে গেছিলেন তাইবার বাবা। জানতেন না, কয়েক বছর বাদে মেয়ের স্বপ্ন সফল হতে চলেছে। সত্যি সত্যি গাড়ি চালাবে তাঁর মেয়ে। তবে সড়কপথে নয়, আকাশে। হাতে স্টেয়ারিংয়ের বদলে তুলে নেবেন ককপিটের ইয়োক। ড্রাইভার নয়, লোকে তাইবাকে পাইলট বলে ডাকবে। ছাপরার অন্ত্যজ এলাকা জালালপুরে বেড়ে ওঠা দরিদ্র পরিবারের এই মুসলিম কন্যা আজ পাইলট। গোটা শহরের মধ্যে প্রথম।
যদিও উড়ান শুরুর আগের জার্নিটা মোটেও সুখকর ছিল না। তাইবার বাবার ছিল একটি ছোট্ট রেশনের দোকান। কোভিডকালে তাও বন্ধ হয়ে যায়। আচমকা দোকান ঝাঁপ ফেলায় আতান্তরে পড়ে তাইবার পরিবার৷ করোনায় আক্রান্ত হন তাঁর বাবা। যমে-মানুষে টানাটানি। কোনওমতে বেঁচে ফেরেন। কিন্তু ততদিনে পাইলট হওয়ার দৌড় শুরু হয়েছে। ভর্তি হয়েছেন ইনস্টিটিউটে। সাধ্যাতীত মাইনে। বাবা দোনোমোনো করলেও তাইবার মা কিন্তু পিছু হটেননি। দু'বার না ভেবেই বেচে দেন সম্বলের একমাত্র জমি। পাড়াপড়শি প্রশ্ন তোলে, খোঁটা দেয়। জবাবে তাইবার ‘আম্মি’ সেদিন একটি কথাই বলেছিলেন: ‘লোকে সন্তানের বিয়ের জন্য জমি বেচে। আমি না হয় মেয়ের ডানা মেলার কথা ভেবে বিক্রি করলাম।’
মায়ের মান রেখেছেন তাইবা। নিরলস পরিশ্রম আর অটুট অধ্যবসায়। দুই মন্ত্রে এসেছে সাফল্য। প্রথমে ভুবনেশ্বরের গভর্নমেন্ট এভিয়েশন ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে ভর্তি। তারপর ২০০ ঘণ্টার উড়ানের পরীক্ষা। ঝড়-ঝঞ্ঝা, বৃষ্টিপাত, বজ্রপাতের ভ্রুকুটি তো ছিলই। আর ছিল আত্মসংশয়ের কুটিল চাহনি। সবকিছু জয়ের পর শেষমেশ পাইলটের মুকুট মাথায় পরেন তাইবা। সেই পরীক্ষামালার কঠিনতম প্রশ্ন কোনটা? খানিক ভেবে ছাপরার ভূমিকন্যার জবাব: ‘১০০ ঘণ্টার একক উড়ানই সবচেয়ে কঠিন অ্যাসিড টেস্ট ছিল।’
যদিও পাইলটের সম্মান জুটলেও সমাজের, ধর্মীয় অনুশাসনের তির্যক চাহনি কিন্তু এতটুকু কমেনি। সাদা রঙের পোশাক গায়ে তাইবাকে দেখামাত্র পড়শি মহিলার বিস্ময়ভরা জিজ্ঞাসা: ‘সবই বুঝলাম। কিন্তু তোমার তো বোরখা পরার কথা ছিল না!’
পিছিয়ে আসেননি, গুটিয়ে যাননি ছাপরার তরুণী। জবাব দিয়েছেন: ‘এই প্যান্টশুট আমার প্রতিভার পোশাক। ভাবাবেগের জন্য ককপিটের কোনও আলাদা ড্রেসকোড নেই। এই ইউনিফর্মই আমার পরিচয়।’
২ থেকে ৩ বছরের ম্যারাথন পড়াশোনা। তারপর থিয়োরি পেপারে ৭০ শতাংশের বেশি নম্বর নিয়ে ট্রেনিং পাশ করেছেন তাইবা। অগ্নিপরীক্ষায় সাফল্যের পুরস্কার পাইলটের সম্মান, মাস গেলে দেড় লাখ টাকার আকর্ষণীয় মাইনে। কিন্তু ছাপরার সাহসিনীর মতে আসল পুরস্কার: বাইরের দুনিয়ার চোখে এলাকার পরিচয় বদলে দেওয়া। আজও ছাপরা, সিওয়ানের মতো বিহারের দুর্দান্ত তল্লাটের কথা উঠলে আমজনতার মনে জেগে ওঠে গুলিবন্দুক আর গ্যাংস্টার লড়াইয়ের কথা। সেই পরিচিতি তাঁর সাফল্যের পর কিছুটা হলেও পাল্টাবে। দিনবদলের স্বপ্নে মশগুল তাইবা আফরোজ।
আর কোনও স্বপ্ন? খানিক ব্যক্তিগত কিছু? হাসিমুখে, কিছুটা লাজুক গোলায়, সামান্য জড়তা নিয়ে তাইবা জানালেন, ‘আমার উড়ানের কথা ভেবে একদিন জমি বিক্রি করেছিলেন যে মা, যে বাবা রেশনের দোকান চালিয়ে পরীক্ষার ফি ভরেছেন, তাঁদের বিমানের সিটে বসাতে চাই। পাশ দিয়ে উড়ে যাবে মেঘের দল, ককপিটে বসে আমি আর প্যাসেঞ্জার সিটে ওঁরা দুজন।‘
তাইবা আফরোজের সাফল্যকে ‘অসাধ্য-সাধন’ বলে কি না জানা নেই৷ কিন্তু তাঁর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিহারের তরুণী প্রমাণ করেছেন: আত্মত্যাগ যেমন বেচা যায় না তেমনই স্টেরিওটাইপও ভাঙা যায় না। আর আকাশের সীমানা? তাও কোনও বাধা নয় মোটেও—স্রেফ শুরুয়াত মাত্র।