দোলন গঙ্গোপাধ্যায়
কাজের জায়গায় মেয়েদের ওপর যৌন হেনস্থা নিয়ে এখন তোলপাড় চলছে। সুখের কথা সেলিব্রিটি মহিলারাও এ বিষয়ে মুখ খুলছেন। গত বছর থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় #meetoo ক্যাম্পেন সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রভাব ফেলেছে। যত বিখ্যাত, প্রতিষ্ঠিত মানুষের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ উঠছে ততই নাগরিক সমাজ চমকে উঠছে। বলে উঠছে, “ইনিও?” আশ্চর্য লাগে আমাদের এই ভন্ডামি দেখে। আমরা যেন জানতাম না যে সর্বস্তরেই মেয়েদের ওপর যৌন হেনস্থা চলে। আবহমান কাল ধরে কলকারখানায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, সংগঠিত, অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরতা মেয়েরা পুরুষ সহকর্মীর যৌন অত্যাচারের শিকার।
১৯৯২-এ রাজস্থানের সরকারি প্রকল্পে সাথিন হিসেবে কর্মরতা ভামরি দেবীকে ধর্ষণ করেন গ্রামের উচ্চ বর্ণের পুরুষেরা। ভামরির অপরাধ যে তিনি ভাতেরি গ্রামে অল্প বয়সী ছেলেমেয়েদের বিয়ের বিরুদ্ধে প্রচারান্দোলন গড়ে তুলছিলেন। ভামরি আইনের দ্বারস্থ হন। রাজস্থানের হাই কোর্ট বলে, কোন উঁচু জাতের পুরুষ নাকি নিম্ন বর্ণের নারীকে স্পর্শ করে না, তাই এ ধর্ষণের অভিযোগ মিথ্যে। পরবর্তীকালে নারী সংগঠনের উদ্যোগে ভামরি দেবী সুপ্রিম কোর্টে অভিযোগ জানান এবং সেখানে দোষীদের শাস্তি হয়।দেশ জুড়ে এ ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। নারী আন্দোলনের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে সুপ্রিম কোর্ট ১৯৯৭-এ গাইড লাইন তৈরি করে। যে গাইড লাইন বিশাখা গাইড লাইন নামে বিখ্যাত। তারপর থেকেই জনপরিসরে, নীতি নির্ধারণের স্তরে এ নিয়ে খোলাখুলি কথাবার্তা চালু হয়। ২০১৩ সালে কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা মোকাবিলা এবং প্রতিরোধের জন্য আইন তৈরি হয়।
আইন তৈরি হওয়ার অর্থ ব্যাপারটি সরকারি মান্যতা পেল। অর্থাৎ এতদিন যে সবাই একটা ভাব করত যে ওসব কিছু হয় না,কাজের জায়গায় মেয়েদের সবাই পুজো করে, সে মনকে চোখ ঠারার দরজা সুপ্রিম কোর্টই বন্ধ করে দিল। কিন্তু এতদসত্ত্বেও কি বাস্তব অবস্থার কোনো পরিবর্তন হল? নারী সহকর্মীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গী কিছুমাত্র বদলাল? আইন হওয়ার পরও বেশীরভাগ প্রতিষ্ঠানই আইনে নির্দেশিত ব্যাবস্থাপনার ধার ধারল না। যারা ইন্টারনাল কমপ্লেনণ্ট কমিটি তৈরী করলেনও তাদের অধিকাংশের মধ্যেই দায়সারা ভাব। সরকার থেকেও আইনের কার্যকারিতা দেখভালের উপযুক্ত পরিকাঠামো তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হল না। আর সবথেকে আশ্চর্য কথা শোনা গেল কর্মস্থলে পুরুষ সহকর্মীদের মুখে। কথায় কথায় তারা ঠেস মেরে বলতে লাগলেন, “বাবা এখন তো আর মেয়েদের কিছু বলা যাবে না, আইসিসি-তে কমপ্লেন্ট ঠুকে দেবে”। এ ধরণের মন্তব্যের সময় পুরুষ সহকর্মী ভাবেন না যে, ‘কিছু বললেই’ মেয়েরা অভিযোগ জানাতে যাবেন কেন, যদি না সেই ‘কিছু বলার’ মধ্যে কোন যৌন উপাদান থাকে?অথবা তারা ভাবেন যে, মেয়েরা ডাহা মিথ্যেবাদী, তাই তারা যৌন হেনস্থা হোক না হোক, পুরুষ সহকর্মীর ওপর অন্য কোন কারণে রাগ হলেও আইসিসি-তে নালিশ করবেন।
আইন হওয়া সত্ত্বেও যে মেয়েরা সচরাচর কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা বিষয়ে কোন অভিযোগ করতে চান না তার অন্যতম কারণ হল, মেয়েদের বিশ্বাস করা হয় না। আইসিসি-তে বসে প্রায়ই অভিযোগকারিণীকে শুনতে হয়, প্রমাণ কী? সমাজ বলে, আগে প্রমাণ হোক। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে অভিযুক্তকে সমর্থন জানিয়ে বলা হয়, “কিন্তু অমুকবাবু তো এতদিন আমাদের সঙ্গে কাজ করছেন! কখনো তো কোন বেচাল শুনিনি”। কিম্বা বলা হয়, “আরে উনি এত সিনিয়র আর ভদ্র মানুষ, উনি কী ভাবে এটা করবেন”। এ ধরণের কথার অর্থই হল, মেয়েটি মিথ্যে কথা বলছে। মেয়েটির ওপর তখন প্রমাণ জোগাড়ের চাপ বাড়ে। একে যৌন হেনস্থার মানসিক বিপর্যয়, তার ওপর আবার নিজেকে সত্যবাদী প্রমাণের দায়িত্ব, দুয়ে মিলে অভিযোগকারিণী ভয়ংকররকম দুর্দশার শিকার হন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়, অভিযোগকারিণীর চরিত্র হননের প্রয়াস। মেয়েটিকে হামেশাই শুনতে হয়, “তুমিও তো অফিস ক্যান্টিনে ওর সঙ্গে চা খেতে যেতে”! অথবা “ছেলেটি হোয়াটসআপে গুড মর্নিং পাঠালেই বা তুমি জবাব দিতে কেন?” অর্থাৎ ভিক্টিম ব্লেমিং! যার ওপর অত্যাচার হল তাকেই প্রমাণ করতে হবে সে সত্যি কথা বলছে, তাকেই প্রমাণ করতে হবে সে অভিযুক্তকে “প্রোভোক” করেনি, সে সচ্চরিত্র মহিলা! বাড়িতে চুরি-ডাকাতি হলে চুরি হয়েছে প্রমাণের দায় গৃহস্থের ওপর বর্তায় না, চোরকেই প্রমাণ করতে হয়, সে নির্দোষ। কিন্তু মেয়েদের জন্য আশ্চর্যজনকভাবে উল্টো সমাজের নিয়ম!
কাজের জায়গায় মেয়েদের প্রতি যৌন হেনস্থা এতই নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার যে এই হেনস্থা একরকমের প্রাতিষ্ঠানিকতা পেয়ে গেছে। সাধারণত ছেলেরা মনে করেন ঘরের বাইরের জগতটা তাঁদের। একসময় হয়তো তাই-ই ছিল খানিকটা। কিন্তু দিন যে বদলেছে সে কথা মানতে তারা নারাজ। সেই কারণেই পাশের ডেস্কে বসা নারী সহকর্মীকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা ক’রে অনেকসময়ই ছেলেরা এ ডেস্ক থেকে ও ডেস্কে যৌনগন্ধী রঙ্গরসিকতা করেন, মোবাইলে পর্ন দেখান। আসলে বেশীরভাগ পুরুষই এই একবিংশতেও নারী সহকর্মীকে যৌন বস্তু হিসেবে মনে করেন এবং তাই যৌন রসিকতা, অযাচিত স্পর্শ ইত্যাদি তাদের কাছে ‘স্বাভাবিক’ মনে হয়। মেয়েরাও যে কর্মী , কাজের জায়গায় নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেরই পেশাদারী পরিবেশে নিরঙ্কুশ অধিকার, একথা মানতে বোধহয় তাদের পৌরুষে বাধে। বেশিরভাগ কর্মস্থলেই কর্মীদের এ বিষয়ে সচেতন করার কোনো প্রয়াসও দেখা যায় না।
কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা মেয়েদের ঘরের বাইরে ব্রাত্য করে রাখার এক রাজনৈতিক চক্রান্ত। এ রাজনীতি অবশ্যই পিতৃতান্ত্রিক রাজনীতি। বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ মেয়েদের অধিকারবোধকে জাগিয়ে তোলে, দৈনন্দিন জীবনে বঞ্চনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সাহায্য করে। তার ওপর রোজগার সবসময়ই মেয়েদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এবং আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। যে মেয়েকে তার বাবা, দাদা, স্বামী সারাক্ষণ হ্যাটা করে এই ব’লে যে তুমি বোকা, বাইরের জগতের কোনো দস্তুর জানো না, সেই মেয়েই যখন বাসে ঝুলতে ঝুলতে অফিস যাতায়াত করে, কাজের জায়গায় প্রোমোশন পায়, তখন ‘অতীব বুদ্ধিমান’ মেল ইগো ক্ষুণ্ণ হয় বৈকি! আর তাছাড়া মেয়েরা বাইরের কাজে বেরোলে হেঁসেল ঠেলবে কে? ঘরে কাজের যাবতীয় বোঝা বাড়ির মেয়েদের ঘাড়ে চাপিয়ে তেল চুকচুকে বাবুটি যে কাজে বেরোন, তাদের মুখের কাছে ভাতের থালা ধরবেন কে? সেই জন্যই মেয়েদের বাইরের জুজু দেখানো হয়। মেয়েরা বাইরে বেরোলে সংসারে বিনা মাইনেয় বেগার খাটার শ্রমিকটি হাতছাড়া হয়ে যাবে। তাই-ই কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা মেয়েদের ঘরবন্দী করে রাখার এক মোক্ষম অস্ত্র। যৌন হেনস্থার কারণে কাজ ছেড়ে দিতে কিম্বা উচ্চাশা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন এমন মেয়েও আকছার দেখা যায়।
কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা আসলে মেয়েদের নিয়ন্ত্রণের, মেয়েদের ওপর ক্ষমতা প্রদর্শনের হাতিয়ার। কাজের জগতে মেয়েদের প্রতিষ্ঠিত হ’তে না দেওয়ার জন্যই তাদের যৌন নিপীড়ন করা হয়। পিতৃ্তন্ত্র চায়, ক্ষমতার সোপানতন্ত্রে মেয়েরা বরাবর নীচের ধাপেই বাস করুক। মেয়েদের বাইরের কাজে সাফল্য এবং রোজগার পিতৃতন্ত্রের সেই ছককে চ্যালেঞ্জ করে। আশার কথা, এই চ্যালেঞ্জ ক্রমশ বাড়ছে। মেয়েরা মুখ খুলছেন, নিজেদের ওপর ঘটে যাওয়া যৌন হেনস্থার কথা সোচ্চারে বলছেনই শুধু নয়, মেয়েরা হেনস্থাকারীর দিকে তর্জনী নির্দেশ ক’রে বলছেন , শুধু ‘মি টু’ নয়, ‘ইউ টু’। অর্থাৎ তুমি আমাকে কাজের জগতে যৌন হেনস্থা করেছ। তুমি যতই তালেবর হও না কেন, যৌন হেনস্থাকারীর তকমা তোমার গায়ে। দোষী আমি নই, নির্যাতনকারী তুমি। লজ্জা আমার নয়, লজ্জা তোমার।
ভামরি দেবীর প্রতিবাদ আজ সার্থক। মেয়েরা আজ আর নীরব ভিক্টিম নয়, সরব প্রতিবাদী।
দোলন গঙ্গোপাধ্যায় একজন সমাজকর্মী।গত দু দশকেরও বেশী সময় পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে ও শহরে মেয়েদের ক্ষমতায়ন বিষয়ে কাজ করছেন।রাজ্যের নারী আন্দোলন এবং মানবাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত